পর্ব -১৫
অদিতি ভোরের আলোতে পথ চলা শুরু করল।
অমাবস্যার ঘণ্টার কালো খণ্ডটা তার বুকে আগুনের মতো জ্বলছে।
যেন প্রতিটি স্পন্দনে তার বয়স আরও একটু ঝরে যাচ্ছে।
তবু তার চোখে একটুখানি ভয়ও নেই।
শুধু গভীর দৃঢ়তা।
পথিকের শেষ কথাটা তার মনে গুঞ্জন করছে—
“রক্তচোখের নদী পার হলে কোনো মিথ্যা লুকানো যাবে না।”
অদিতি নিজের ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করল—
“আমার ভালোবাসায় মিথ্যা নেই।”
সন্ধ্যা নামতেই দূরে দেখা গেল নদীটা।
পানি নয়, পুরো নদী লালচে আলোয় ঝলমল করছে।
দেখলে মনে হয় রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
পানি নয়, আসলে চোখ—
হাজার হাজার চোখ ভেসে আছে নদীর জলে,
প্রতিটি চোখের ভেতরে ভাসছে লুকিয়ে রাখা স্মৃতি।
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
“এই নদী… আমার সত্য উন্মোচন করবে।”
সে নদীতে পা রাখতেই জলের চোখগুলো একসাথে তাকালো তার দিকে।
কানে কানে শোনা গেল—
“অদিতি… তুমি কি সত্যিই ভালোবেসেছো? নাকি অর্ণব তোমার কাছে শুধু স্বপ্নের অংশ?”
হঠাৎ জলের ভেতর থেকে ভেসে উঠল তার নিজের পুরনো চেহারা—
অদিতি, কিশোরী বয়সে, বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
সে ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল—
“তুমি কখনো অর্ণবকে সবকিছু বলোনি। তুমি ভেবেছিলে, সে তোমাকে দুর্বল ভাববে।”
অদিতির চোখে জল এলো।
“হ্যাঁ… আমি অনেক কিছু লুকিয়েছি। কিন্তু ভালোবাসা কখনো মিথ্যা ছিল না।”
নদী গর্জে উঠল, জল ফুলে উঠল, যেন স্বীকার করছে তার কথা।
অন্যদিকে আয়নার গভীর স্তরে অর্ণব হেঁটে বেড়াচ্ছে এক শূন্য প্রান্তরে।
চারপাশে শুধু সাদা ধুলো আর ভাঙা আয়না।
হঠাৎ আয়নায় ভেসে উঠল অদিতি—
সে রক্তচোখের নদীতে লড়ছে।
অর্ণব চিৎকার করল—
“অদিতি! থামো! ওই নদী তোমাকে গ্রাস করবে!”
অদৃশ্য কণ্ঠ হেসে উঠল—
“সে তোমার জন্যই সব করছে। কিন্তু তুমি কি প্রস্তুত তাকে সত্যিই হারানোর জন্য?”
অর্ণব হাঁটুতে ভর করে পড়ে গেল।
তার চোখে ভয়, কিন্তু ঠোঁটে একটিই কথা—
“আমি চাই না অদিতি মরে যাক। যদি কিছু দিতে হয়, তবে আমার জীবন নিক।”
অদিতি নদীর মাঝ বরাবর পৌঁছে গেছে।
জলের চোখগুলো এবার ভয়ঙ্কর আলো ছড়াল।
একটি বিশাল চোখ ভেসে উঠল সামনে।
তার কণ্ঠ আকাশ কাঁপিয়ে দিল—
“অদিতি, যদি একদিন অর্ণব তোমাকে ভুলে যায়, তুমি কি বাঁচতে পারবে?”
অদিতি থমকে দাঁড়াল। বুক ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়।
চোখ বন্ধ করে বলল—
“আমি বাঁচব না।
কিন্তু আমি চাইবো, সে যেন সুখে থাকে… আমার ছাড়া হলেও।”
নদী গর্জে উঠল, তারপর শান্ত হলো।
সব চোখ মিলিয়ে গেল।
অদিতি দেখল তার হাতে ভেসে উঠছে এক টুকরো নীল আলো—
তৃতীয় রহস্য, সত্যের কণা।
অদিতি নদী থেকে বেরোতেই সামনে আবার পথিক দাঁড়িয়ে।
তার চোখ এবার আরও স্পষ্ট, অদ্ভুত মমতায় ভরা।
সে মৃদু কণ্ঠে বলল—
“তুমি সত্যিই ভয়হীন।
কিন্তু অদিতি… তুমি কি জানো, প্রতিটি রহস্য জয়ের সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমাকে আরও কাছে টেনে নিচ্ছো?”
অদিতি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল—
“আপনি কে? কেন বারবার আমার সামনে আসেন?”
পথিক শুধু অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, রেখে গেল এক রহস্যময় প্রতিধ্বনি—
“আমি তোমার ছায়া, অদিতি। একদিন তুমি বুঝবে।”
অদিতি বুকে সত্যের কণা চেপে ধরল।
তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু আগুনও।
পরের গন্তব্য—অলীক সিঁড়ি।
চলবে…
