পর্ব -১৪
অদিতি ঘণ্টার সামনে দাঁড়িয়ে। তার হাত থরথর করছে, কিন্তু চোখে এক অদম্য দৃঢ়তা। ছায়ামুকুটধারী রক্ষক আবার গর্জে উঠল—
—“মনে রেখো, একবার বাজালে আর ফেরানো যাবে না। তোমার জীবন কমতে থাকবে।”
অদিতি ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। তার মনে ভেসে উঠল অর্ণবের মুখ, তার অনিদ্রার ক্লান্ত চোখ, আর সেই মৃদু হাসি।
“অর্ণবকে আমি হারাতে পারব না।”
সে দড়িতে টান দিল।
ধাম—!
এক অদ্ভুত সুর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শব্দটা ধাতব নয়, যেন সময় নিজেই কেঁপে উঠল। আকাশ অন্ধকার থেকে হঠাৎ রক্তলাল হয়ে গেল। নদীর থেমে থাকা ঢেউ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল, শুকনো পাতা হাওয়ায় উড়ে আবার মাটিতে জমল।
অদিতি অনুভব করল—তার শরীর থেকে আলো ঝরছে, যেন প্রতিটি ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে তার বয়স ঝরে যাচ্ছে। কপালের কাছে হালকা সাদা চুল, শিরদাঁড়ায় তীব্র যন্ত্রণা।
কিন্তু একই সঙ্গে সে অনুভব করল—ঘুমপুরের জগতে একটা অচেনা দরজা খুলে গেছে।
ওদিকে আয়নার জগতে অর্ণব হঠাৎ টের পেল বুকের ভেতর এক প্রবল আলো প্রবেশ করছে।
সে হাঁফ ছেড়ে উঠল—
—“অদিতি… তুমি ঘণ্টা বাজিয়েছো!”
তার চারপাশের আয়না ভেঙে গিয়ে ধুলোয় পরিণত হলো। অর্ণব অনুভব করল, সে এক নতুন স্তরে পৌঁছেছে—যেন ঘুমপুর তাকে ছেড়ে দিচ্ছে না, বরং আরও গভীরে টেনে নিচ্ছে।
এক অদৃশ্য কণ্ঠ ভেসে এলো—
—“ভালোবাসার জন্য তুমি সময়কে ভাঙলে। কিন্তু সময় তোমাকে ছেড়ে দেবে না।”
অদিতি আবার ঘণ্টা বাজাল। রক্ষক গর্জে উঠল, তার ছায়ামুকুট আগুনের মতো দপদপ করতে লাগল। হঠাৎ সে ধুলোয় মিশে গেল, শুধু রেখে গেল এক কালো খণ্ড—যেন সময়ের জমাট অংশ।
অদিতি হাঁপাতে হাঁপাতে সেই খণ্ড তুলে নিল।
পথিক ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে মৃদু হাসল।
—“তুমি দ্বিতীয় রহস্য অর্জন করলে। কিন্তু তোমার জীবন থেকে কয়েক বছর এখনই ঝরে গেল। এটা তুমি টের পাচ্ছো, তাই না?”
অদিতি ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়ল।
—“আমি থামব না। অর্ণবের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত কিছুতেই থামব না।”
পথিক অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল—
—“তৃতীয় রহস্য আরও ভয়ঙ্কর। তার নাম—‘রক্তচোখের নদী’। যেই নদী পার হবে, তার ভেতরের সমস্ত সত্য বেরিয়ে আসবে। নিজের মিথ্যা লুকানো যাবে না।”
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
—“আমার কোনো মিথ্যা নেই।”
পথিক ঠান্ডা হেসে বলল—
—“সেটা আমরা সময়মতো বুঝব।”
তার চোখে এক অদ্ভুত অন্ধকার জ্বলে উঠল, যেন সে অদিতির প্রতিটি শ্বাস দেখছে।
রাত গভীর। অদিতি নদীর ধারে বসে আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদহীন আকাশে তারারা ঝলমল করছে।
তার ঠোঁট থেকে মৃদু শপথ বেরিয়ে এলো—
—“অর্ণব, আমি দ্বিতীয় রহস্য পেয়েছি। আমি আর পিছিয়ে যাব না। যতটা জীবন আমার আছে, সব আমি তোমার জন্য বিলিয়ে দেব।”
নদীর জলে প্রতিচ্ছবি ঝিলমিল করল। অর্ণবের কণ্ঠ যেন আবার ভেসে এলো—
—“অদিতি, থেমো না। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।”
অদিতির চোখ ভিজে গেল, কিন্তু তার ভেতর আরও শক্তি জন্ম নিল।
এবার তার গন্তব্য—রক্তচোখের নদী।
( চলবে....)
