অসুরের ইন্টারভিউ
অভিজিৎ হালদার
অফিসের কনফারেন্স রুমটা আজ একটু অদ্ভুত রকমের সাজানো। টেবিলের উপর রাখা ক্রিস্টালের জগ, একপাশে গরম কফির ধোঁয়া, আরেকপাশে চকচকে ফাইল। বাইরে শহরের ট্রাফিকের হর্ন, ভেতরে কাঁচের দেয়ালে নীরবতা।
ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে আছেন তিনজন—একজন মালিক, একজন মানবসম্পদ কর্মকর্তা, আরেকজন সাইকোলজি বিশেষজ্ঞ। আজ তারা যে প্রার্থীকে ডাকছেন, তার জীবনবৃত্তান্ত দেখে সবার চোখ কপালে উঠেছে।
ফর্মে নাম লেখা—অসুর চক্রবর্তী।
সবাই ভেবেছিল মজা করছে কেউ। কিন্তু ঘড়ি যখন ১১টা বাজল, কাঁচের দরজা ঠেলে সত্যিই ঢুকলেন তিনি। লম্বা, কালো স্যুট পরা, মুখে অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস, চোখদুটো গভীর অথচ কেমন যেন লালচে আভা।
মানবসম্পদ কর্মকর্তা হেসে বললেন,
— "মিস্টার চক্রবর্তী, দয়া করে বসুন। তবে একটা কথা জানতে চাই—আপনার নামটা সত্যি, নাকি মজার ছলে লেখা?"
লোকটা আস্তে হেসে বলল,
— "না, নাম সত্যি। তবে আমি নামের চেয়েও আসল অসুর। মানুষের ভিড়ে আমি লুকিয়েই আছি বহুদিন ধরে। আজ এসেছি আপনাদের দেখাতে, কীভাবে এই সমাজে অসুররাই সব পদে দাপিয়ে বেড়ায়।"
কনফারেন্স রুমে হালকা কাঁপুনি বয়ে গেল। সাইকোলজি বিশেষজ্ঞ কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
— "মানে?"
অসুর টেবিলের উপর হাত রেখে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—
"আপনারা মানুষরা ভাবেন অসুর মানেই দাঁতাল, রক্তচক্ষু, পাহাড় ভাঙা শক্তির দানব। ভুল। আধুনিক যুগে অসুররা টাই পরে, মোবাইল হাতে, দামী গাড়িতে ঘোরে। এদের কাজ হলো—
মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষ ঠকানো,
দুর্নীতিকে প্রাত্যহিক প্রয়োজন বানানো,
কারও স্বপ্নকে টাকার তালে বেচে দেওয়া,
দুর্বলকে চেপে ধরে ক্ষমতার আসন আঁকড়ে ধরা।
এই অফিসের প্রতিটি করিডরে, আদালতের প্রতিটি টেবিলে, সংসদের প্রতিটি আসনে আমাদের মানুষরূপী অসুরেরা আছে।"
কথা শুনে মালিক হেসে ফেললেন,
— "এত নাটকীয় হতে হবে না, মিস্টার চক্রবর্তী। আপনার দক্ষতার কথা বলুন। কোম্পানির জন্য কী করতে পারবেন?"
অসুর গম্ভীর হয়ে বলল,
— "আমি জানি কিভাবে কর্মীদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে শেষ ফোঁটা পরিশ্রম বের করে নিতে হয়। কিভাবে বাজারে ভুয়া প্রচার চালিয়ে গ্রাহকের পকেট খালি করা যায়। আর জানেন তো? আমি মানুষের ভয়কে খুব ভালো বুঝি। ভয়কে ব্যবহার করতে পারলে ব্যবসায় লাভ অনেকগুণ বেড়ে যায়।"
মানবসম্পদ কর্মকর্তা হকচকিয়ে গেলেন। তিনি তো প্রতিদিন এরকম কৌশলই ব্যবহার করেন, শুধু নামটা দেন "ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি"।
সাইকোলজি বিশেষজ্ঞ হঠাৎ থেমে বললেন,
— "আপনি কি বলতে চাইছেন, আমাদের সমাজের ভেতরে ইতিমধ্যেই অসুরেরা চাকরি করছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, শাসন করছে?"
অসুর ঠান্ডা হেসে উত্তর দিল,
— "না, বলছি না। প্রমাণ করছি। চারপাশে তাকান—
যে রাজনীতিক ভোটের আগে মিথ্যা হাসি নিয়ে দরিদ্রের ঘরে ঢোকে, সে অসুর।
যে ব্যবসায়ী শ্রমিকের রক্ত চেপে গাড়ি পালিশ করে, সে অসুর।
যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্ঞানের নামে টাকা চুষে নেয়, সে অসুর।
যে প্রেমিক ভালোবাসার নামে কেবল ভোগ চায়, সেও অসুর।
আমি কেবল সাক্ষাৎকার দিতে এসেছি, বাকি সবাই তো আপনারা চেনেন।"
কনফারেন্স রুমে নীরবতা নেমে এল। তিনজন বোর্ড মেম্বারের চোখে যেন নিজেদের ছায়া ভেসে উঠল। মালিকের মনে পড়ল, তিনি কীভাবে মিথ্যা কাগজপত্রে কোটি টাকা লোন নিয়েছিলেন। মানবসম্পদ কর্মকর্তার মনে পড়ল, কত তরুণের স্বপ্ন কেটে তিনি রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন। আর মনোবিজ্ঞানীও হঠাৎ বুঝলেন, তিনি কত বছর ধরে অসুস্থ মনের চিকিৎসা না করে ওষুধ কোম্পানির কমিশন বাড়িয়েছেন।
অসুর উঠে দাঁড়াল। বলল—
— "আমাকে চাকরি দিতে হবে না। আপনারা তো আমিই। কেবল নামটা আলাদা।"
এ কথা বলে সে বেরিয়ে গেল।
বাইরে তখন শহরের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, মানুষের ভিড়। কিন্তু কনফারেন্স রুমের ভেতরে তিনজন মানুষ এক অদ্ভুত ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। তারা হঠাৎই বুঝে ফেললেন—
অসুরকে ইন্টারভিউ নেবার দরকার নেই। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না
কোনোভাবে ইতিমধ্যেই অসুর।
••• সমাপ্ত •••