ঘুমের শহর
অভিজিৎ হালদার
ভূমিকা
মানুষ যখন ঘুমোয়, তখন তার ভেতরের অচেনা দরজা খুলে যায়। কেউ দেখে স্বপ্ন, কেউ দেখে দুঃস্বপ্ন, আর কেউ শুধু অন্ধকার। কিন্তু কোথাও নাকি আছে এমন এক গ্রাম—যেখানে ঘুম মানেই নতুন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করা।
সেই গ্রামের নাম ঘুমপুর।
এই গল্পে আমরা অনুসরণ করব এক তরুণ অর্ণবকে, যার অনিদ্রা তাকে টেনে নিয়ে আসে এই রহস্যময় গ্রামে। আর সেখানে তার দেখা হবে এক অদৃশ্য মেয়ের সঙ্গে—অদিতি।
তাদের প্রেম, দুঃখ আর সিদ্ধান্ত ঘিরেই খুলে যাবে ঘুমের শহরের দরজা।
------------------------------------------
পর্ব -১
অর্ণবের রাতগুলো অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। শহরের কোলাহলের ভিড়ে, ইট-পাথরের খাঁচার ভেতরে, তার কাছে সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠেছিল রাত। সূর্য অস্ত গেলেই তার শরীরটা যেন আর নিজের কথা শুনত না। চোখের পাতাগুলো হালকা হলেও তন্দ্রা আসত না। বিছানার একপাশ থেকে অন্যপাশে গড়াগড়ি খেতে খেতে সে যেন নিজেকে ধ্বংস হতে দেখত।
প্রথমে ভেবেছিল কাজের চাপ, হয়তো মন একটু ফাঁকা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। পরে ডাক্তার দেখাল—প্রথম ডাক্তার ঘুমের বড়ি দিলেন, দ্বিতীয় ডাক্তার মেডিটেশনের পরামর্শ দিলেন, তৃতীয় ডাক্তার বললেন, “অতিরিক্ত ভয় আর দুশ্চিন্তা। মনকে শান্ত করো।” কিন্তু কেউই তাকে ঘুম এনে দিতে পারল না। বড়িগুলো প্রথমে কাজ করেছিল বটে, কিন্তু কিছুদিন পর সেগুলোও নিস্ফল হয়ে গেল।
অর্ণব ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়তে লাগল। দিনের বেলায় সে কাজ করত, কিন্তু মাথার ভেতর কুয়াশা জমে থাকত। অফিসের কাগজে ভুল হতো, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতেও ইচ্ছে হতো না। তার চোখের নিচে কালো দাগ গাঢ় হয়ে উঠছিল, চুল অগোছালো, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছিল। মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলত, “ঘুম পাচ্ছে না।”
এমন সময় একদিন, হঠাৎই এক গ্রন্থাগারে ঢুকে পড়ে অর্ণব। বৃষ্টি হচ্ছিল প্রবল, সে আশ্রয় খুঁজতে ঢুকেছিল। ভেতরে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, বুকশেলফে ধুলো জমে আছে। কিন্তু সেই ধুলোর ভেতরেই তার হাতে আসে এক অদ্ভুত বই। বইটির প্রচ্ছদে কোনো নাম নেই, শুধু অক্ষরের মতো দেখতে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন। ভিতরে খুলে দেখে প্রথম পাতায় লেখা—
“ঘুমপুরের কাহিনি।”
পাতা উল্টাতেই তার চোখ আটকে গেল এক বাক্যে—
“যে মানুষ সত্যিই ঘুম হারায়, তাকে ঘুমপুর ডাক দিয়ে নিয়ে যায়।”
অর্ণব প্রথমে অবিশ্বাসে হাসল। কিন্তু বইটা পড়তে পড়তে তার ভেতরে কেমন যেন টান অনুভব হলো। তাতে লেখা ছিল, ঘুমপুর হলো পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এক গ্রাম, যেখানে মানুষ গেলে ঘুম ফিরে পায়। তবে সেই ঘুম চিরকালীন শান্তির মতো; কেউ ঘুমিয়ে পড়লে আর জেগে উঠতে চায় না।
“হয়তো আজগুবি কাহিনি,”—মনে মনে বলল অর্ণব। তবু বুকের ভেতর কেমন এক আলোড়ন ছুটে গেল। যদি সত্যিই এমন গ্রাম থাকে? যদি সেখানে গেলে ঘুম মেলে?
সেই রাতেই সে সিদ্ধান্ত নিল—যা-ই হোক, তাকে ঘুমপুর খুঁজে বের করতেই হবে।
•••••••••••••••
দুই দিন পর অর্ণব ব্যাগ গোছাল। অফিসে অসুস্থতার ছুটি দেখাল, ফোন বন্ধ করল। শহর ছেড়ে রওনা হলো পাহাড়ের দিকে। ট্রেন থেকে নেমে লোকাল বাসে, সেখান থেকে খচ্চরে চড়ে এগোতে লাগল সে। পথ ক্রমেই নির্জন হতে লাগল। আকাশে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে, চারপাশে পাইন আর অচেনা বৃক্ষ।
এক জায়গায় এসে বাসচালক বলল, “এখানেই নামবেন। এর পর আর কোনো রাস্তা নেই।”
অর্ণব চারদিকে তাকাল—একেবারেই অচেনা, ঘন জঙ্গলের ভেতর ছোট্ট এক মাটির রাস্তা চলে গেছে। সে হাঁটতে লাগল। কুয়াশা ঘন হতে লাগল, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে কেউ তাকে গভীর কোনো গহ্বরের দিকে টেনে নিচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার চোখে পড়ল কাঠের তৈরি পুরনো এক ফলক। তাতে মোটা হরফে লেখা—
“স্বাগতম, ঘুমপুরে।”
অর্ণব থমকে দাঁড়াল। বুকের ভেতর কেমন যেন ধক করে উঠল। তার মনে হলো, বহু বছর ধরে কোনো জায়গা তাকে ডাকেনি, অথচ এই ছোট্ট কাঠের সাইনবোর্ড যেন তাকে নিজের করে নিল মুহূর্তেই।
গ্রামে ঢুকতেই সে দেখল, আশ্চর্য রকম শান্ত পরিবেশ। বাড়িগুলো মাটির, কিন্তু ছিমছাম। আকাশ থেকে হালকা কুয়াশা নেমে এসেছে, যেন সকাল-সন্ধ্যার ভেদ নেই। চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা, শুধু কোথাও দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ।
অর্ণব ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা অনুভব করল। এ কেমন গ্রাম? এতো চুপচাপ কেন? মানুষজন কোথায় গেল?
হঠাৎই এক বৃদ্ধা তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাথায় সাদা ওড়না, চোখে গভীর অচেনা দৃষ্টি। তিনি মৃদুস্বরে বললেন—
“তুমি কি ঘুমপুর খুঁজতে এসেছ?”
অর্ণব হতভম্ব।
“হ্যাঁ… কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
বৃদ্ধা হেসে উঠলেন।
“যারা ঘুম হারায়, তাদের পদশব্দ এখান থেকে শোনা যায়। তুমি এসেছ ঠিক জায়গায়। কিন্তু মনে রেখো—এখানকার প্রতিটি ঘুমেরও একটা মূল্য আছে।”
অর্ণব অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতর একদিকে ভয়, অন্যদিকে আশ্চর্য প্রশান্তি।
সেদিন রাতেই, ঘুমপুরের এক খালি কুটিরে আশ্রয় নিল সে। বিছানায় শুয়ে অর্ণব জানালার বাইরে তাকাল—আকাশজুড়ে ম্লান চাঁদ, কুয়াশার ভেতর তারার ঝিলিক।
আর হঠাৎই তার চোখ ভারী হয়ে আসতে লাগল। বহু বছর পর যেন ঘুমের দেবতা তাকে ডাকল।
চোখ বন্ধ হতেই সে শুনল এক নারীকণ্ঠ—
“ভয় কোরো না, আমি আছি।”
অর্ণব বিস্ময়ে শিউরে উঠল।
কণ্ঠস্বরটা কি সত্যিই কারও? নাকি ঘুমপুরের রহস্যময় ঘুম তাকে প্রথমবারের মতো স্বপ্নের দরজায় নিয়ে যাচ্ছে?
অর্ণব জানত না, তার শরীর ঠিক কবে ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করল। এতদিনের অস্থিরতা, রাতভর ছটফট করা, বিছানার চাদর ভিজিয়ে দেওয়া ক্লান্তি — সব যেন মিলিয়ে গেল। এক অদ্ভুত কোমল অন্ধকার তাকে আচ্ছন্ন করে নিল।
কিন্তু সেই অন্ধকার নিঃশব্দ ছিল না।
সে শুনল ঝরনার মতো টুপটাপ শব্দ, যেন দূরে কোথাও জল পড়ছে। বাতাসে গন্ধ এল অপরিচিত ফুলের, যা শহরে কোনোদিন সে পায়নি। চোখ খুলে দেখে অবাক হয়ে গেল —
সে বিছানায় নেই।
সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল মাঠে। আকাশ নীলাভ অন্ধকার, তারাগুলো ঝরে পড়ছে আলোর বিন্দু হয়ে। দূরে, গাছের ফাঁক গলে নদী বয়ে চলেছে। নদীর জলে যেন চাঁদ ভেসে আছে, কিন্তু চাঁদটা শহরের মতো নয় — অনেক বড়, অনেক কাছে, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।
অর্ণব প্রথমে ভয় পেল। কিন্তু সেই ভয়ের ভেতরেই ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
ঠিক তখনই সে শুনল এক নারীকণ্ঠ — সেই কণ্ঠস্বর, যেটা সে ঘুমোতে যাওয়ার মুহূর্তে শুনেছিল।
“ভয় কোরো না, আমি আছি।”
অর্ণব ঘুরে দাঁড়াল।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। সাদা পোশাকে আবৃত, লম্বা চুল বাতাসে উড়ছে, মুখে অদ্ভুত আলো। তার চোখ গভীর, যেন বহু শতাব্দীর গল্প লুকিয়ে আছে সেখানে।
অর্ণব হতভম্ব হয়ে শুধু জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কে?”
মেয়েটি হেসে উঠল — তার হাসি যেন ঝরনার জলের মতো টলমল।
“আমার নাম অদিতি। আমি এই ঘুমপুরের ছায়া।”
“ছায়া?” — অর্ণব বিস্মিত।
“মানে কী? তুমি কি মানুষ নও?”
অদিতি মাথা নাড়ল।
“মানুষ একসময় ছিলাম। কিন্তু এখন আমি কেবল এই ঘুমের জগতেই আছি। যাদের ঘুম হারিয়ে যায়, তাদের স্বপ্নে আমি পথ দেখাতে আসি।”
অর্ণব তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কতদিন ধরে কারও চোখে এভাবে তাকানো হয়নি তার। শহরে মানুষ তাকে চিনত কাজের মানুষ হিসেবে, কিংবা একঘেয়ে সহকর্মী হিসেবে, কিন্তু কেউ তার ভেতরের ক্লান্তি বুঝত না। অথচ এই অদিতি — এক মুহূর্তেই যেন সব বুঝে ফেলল।
“তাহলে তুমি-ই আমাকে এখানে এনেছ?” — অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
অদিতি হাসল।
“না, তোমাকে এনেছে তোমার নিজের ঘুম। আমি শুধু তার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি যে এতদিন ঘুম খুঁজছিলে, সেই আকাঙ্ক্ষাই তোমাকে এখানে টেনে এনেছে।”
অর্ণব হঠাৎ লক্ষ্য করল, তার শরীর হালকা লাগছে। কোনো দুশ্চিন্তা নেই, কোনো যন্ত্রণা নেই। যেন সে অন্য একজন মানুষ।
“এ জায়গাটা… এত সুন্দর। সত্যিই কি এটা শুধু স্বপ্ন?”
অদিতি তার হাত বাড়িয়ে দিল।
“তুমি চাইলে এটাকে বাস্তবও মনে হতে পারে। তবে মনে রেখো, এ ঘুমের জগত। এখানে সবকিছুই সুন্দর, কিন্তু স্থায়ী নয়।”
অর্ণব হাত বাড়িয়ে অদিতির আঙুল ছুঁয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই এক বিদ্যুতের মতো স্রোত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে গেল। সে বুঝল — এ মেয়েটি স্বপ্ন হলেও, তার স্পর্শ সত্যি।
“অদিতি…” — অর্ণবের গলায় কাঁপন।
“আমি কি তোমাকে আবার দেখতে পাব?”
অদিতি নীরব হলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
“প্রতিটি রাতে, যতক্ষণ তুমি ঘুমপুরে থাকবে।”
হঠাৎ দূরে বজ্রপাত হলো, আকাশের আলো ঝলসে উঠল। বাতাসে অদ্ভুত এক শীতলতা নেমে এল। অদিতি অর্ণবের চোখে চোখ রেখে বলল,
“কিন্তু সাবধান, অর্ণব। ঘুম যত গভীর হয়, মানুষ তত দূরে চলে যায় জাগরণ থেকে। তুমি যদি আমার সঙ্গে বেশিদিন থাকতে চাও, তবে হয়তো আর জাগতেই চাইবে না।”
অর্ণবের বুক ধকধক করতে লাগল। সে কি চিরকালের জন্য এখানে থাকতে চাইবে?
কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আকাশ কালো হয়ে এল। চারদিক ঝাপসা হয়ে গেল।
অর্ণব চমকে উঠল।
চোখ খুলে দেখল — সে আবার ঘুমপুরের কুটিরে শুয়ে আছে। জানালার বাইরে ভোরের আলো ফুঁটে উঠছে।
তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। তার মনে হলো বহু বছর পর এভাবে সে ঘুম থেকে জেগে উঠল।
কিন্তু তার মনে একটাই প্রশ্ন বাজতে লাগল—
অদিতি কি সত্যিই স্বপ্ন ছিল, নাকি ঘুমপুরের বাস্তব?
পর্ব -৩
ভোরের আলো কুটিরের জানালা ভরিয়ে দিলেও অর্ণবের ভেতরে কেমন এক শূন্যতা তৈরি হলো। তার শরীর দীর্ঘদিন পর এতটা বিশ্রাম পেলেও মন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে — অদিতি কোথায়? সে কি সত্যিই শুধু স্বপ্ন ছিল?
বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থেকে সে উঠে বাইরে এল। ঘুমপুর তখনও নিস্তব্ধ। চারপাশে কুয়াশা, মাটির বাড়িগুলো ধোঁয়াটে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে হালকা বাতাস বয়ে আসছে।
গ্রামটা যেন অদ্ভুত। এখানে কোনো শিশুদের কোলাহল নেই, নেই বাজারের চিৎকার, নেই পাখির কলকাকলি। সবকিছুই যেন ধীরগতি, সময়ের হাত এখানে অন্যরকমভাবে চলে।
অর্ণব গ্রামের সরু গলির দিকে হাঁটতে লাগল। একসময় দেখতে পেল সেই বৃদ্ধাকে, যিনি আগের দিন তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি কুয়ো থেকে জল তুলছিলেন। অর্ণব কাছে গিয়ে নম্র কণ্ঠে বলল—
“আপনিই কি আমাকে ঘুমপুরে আসতে বলেছিলেন?”
বৃদ্ধা তাকালেন। চোখদুটো লালচে, কিন্তু গভীর।
“আমি কাউকে কিছু বলি না, বাবু। তুমি নিজেই ডাক শুনে এসেছ।”
অর্ণব কুণ্ঠিত গলায় বলল—
“আমি… আমি স্বপ্নে একজনকে দেখেছি। তার নাম অদিতি। সে বলেছে সে ঘুমপুরের ছায়া।”
বৃদ্ধা মুহূর্তে চমকে উঠলেন। হাত থেকে কলসিটি পড়ে গেল। কুয়োর ধারে জল ছলকে উঠল।
তিনি থরথর কণ্ঠে বললেন—
“অদিতি? তুমি তার নাম নিয়েছ?… তাহলে সে তোমাকে বেছে নিয়েছে।”
অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল।
“মানে কী? অদিতি আসলে কে? আমি কি সত্যিই স্বপ্ন দেখেছি, নাকি সে বাস্তব?”
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বললেন—
“শোনো, অদিতি একসময় এই গ্রামের মেয়ে ছিল। বহু বছর আগে, তার বয়স তখন খুব কম। সে একজন বাইরের লোককে ভালোবেসেছিল, ঠিক তোমার মতো। কিন্তু সেই লোক একদিন আর ফিরে আসেনি। অদিতি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, আর শেষ পর্যন্ত নদীতে ডুবে যায়।”
অর্ণবের গলায় কাঁপন।
“মানে… সে আত্মহত্যা করেছিল?”
“হ্যাঁ।” — বৃদ্ধার কণ্ঠ গম্ভীর।
“তারপর থেকে তার আত্মা এখানে ঘুরে বেড়ায়। তাকে আমরা ছায়া বলি। সে শুধু তাদের কাছেই আসে, যাদের ঘুম হারিয়ে গেছে। সে তাদের মায়া দেখায়, শান্তি দেয়। কিন্তু মনে রেখো — যে মানুষ সত্যিই তার প্রেমে পড়ে, সে আর কখনো জাগতে পারে না। চিরকাল ঘুমের ভেতরে বন্দি হয়ে যায়।”
অর্ণব স্তম্ভিত। চারপাশের কুয়াশা যেন আরও ঘন হয়ে উঠল। তার কানে প্রতিধ্বনির মতো বাজতে লাগল — “চিরকাল ঘুমের ভেতরে বন্দি হয়ে যায়…”
সে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু গলা শুকিয়ে গেছে। তখনই হঠাৎ দূর থেকে কণ্ঠ ভেসে এল —
“অর্ণব…”
সে ঘুরে দাঁড়াল। কুয়াশার ভেতর এক মেয়ের অবয়ব। সাদা পোশাক, লম্বা চুল।
অদিতি।
বৃদ্ধা ভয়ে পিছিয়ে গেলেন।
“না… এ সময়ে নয়… ও এখনই এসেছে!”
অর্ণব কিছু বোঝার আগেই অদিতি এগিয়ে এল। তার চোখে মায়ার ঢেউ।
“তুমি আমাকে খুঁজছ না, অর্ণব?”
অর্ণব কাঁপা গলায় বলল—
“তুমি… তুমি কি সত্যিই আছ? নাকি তুমি শুধু আমার ঘুম?”
অদিতি মৃদু হাসল।
“ঘুম আর বাস্তবের মাঝখানে যে সীমারেখা আছে, আমি সেখানেই দাঁড়াই। তুমি চাইলে আমাকে স্বপ্ন ভাবতে পারো, চাইলে বাস্তবও।”
বৃদ্ধা দূর থেকে কেঁপে ওঠা গলায় চিৎকার করলেন—
“ওর কাছে যেও না! অদিতির মায়ায় যে জড়ায়, সে আর জাগতে পারে না। তুমি ধ্বংস হবে, ছেলে!”
কিন্তু অর্ণবের বুকের ভেতর তখন কেমন এক অদ্ভুত টান। সে চেয়েছিল অদিতিকে ছুঁতে, তাকে কাছে টেনে নিতে। অদিতি হাত বাড়িয়ে দিল।
“চলো, তোমাকে একটা জায়গা দেখাই।”
অর্ণব হাত বাড়িয়ে দিল কি দিল না, হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে গেল। এক ঝলক বাতাস এসে চারদিক কেঁপে উঠল। অদিতির অবয়ব হাওয়ায় ভেসে মিলিয়ে গেল।
অর্ণব হাঁফাতে লাগল। তার বুকের ভেতর ধ্বনি বাজছিল—
“আমি কি সত্যিই হারিয়ে যাব, যদি অদিতির হাত ধরি?”
বৃদ্ধা কাছে এসে কাঁপা হাতে তার কাঁধ ছুঁয়ে বললেন—
“তুমি যদি বাঁচতে চাও, মনে রেখো — ঘুমপুরের প্রতিটি ছায়া একদিন মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে যায়। অদিতি তোমার মায়া হতে পারে, কিন্তু তোমার মুক্তি নয়।”
অর্ণব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত — অদিতি ছাড়া তার আর কোনো মুক্তি নেই।
পর্ব -৪
দিনের আলো ঘুমপুরে যেমন আসে, তেমনি আবার অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দও থেকে যায়। অর্ণব ভেবেছিল ভোর হলে গ্রামে জীবন দেখা যাবে—শিশুরা দৌড়াবে, নারীরা রান্নাঘরে ধোঁয়া তুলবে, পুরুষেরা মাঠে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, ঘুমপুরে সকালও যেন রাতের মতো স্থির।
অর্ণব সেই বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে লাগল। চারদিকে কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতলা হচ্ছে, ঘরগুলোর দরজা আধখোলা, তবু ভেতরে কারও উপস্থিতি নেই। যেন এই গ্রামটা মানুষে ভরলেও তাদের অস্তিত্ব কেবল ছায়ার মতো।
তার মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—অদিতি কি সত্যিই আমার জন্য এসেছে? নাকি সে কেবল মৃত্যুর দূত?
সেদিন দুপুরে অর্ণব গ্রামের মাঝখানে গিয়ে বসেছিল। সেখানে একটা পুরনো বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছটার গুঁড়িতে শ্যাওলা লেগেছে, শিকড় ঝুলে নেমেছে মাটিতে। চারপাশে নীরবতা। ঠিক তখনই এক যুবক এগিয়ে এল। তার মুখ শুকনো, চোখ লালচে। গলায় অদ্ভুত বিষণ্নতা। সে এসে বসে পড়ল অর্ণবের পাশে।
“তুমি নতুন এসেছ, তাই তো?”
অর্ণব মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ। আমি ঘুম খুঁজতে এসেছি।”
যুবক হেসে উঠল—তার হাসি যেন ব্যথার ফোঁটা।
“আমরা সবাই তাই এসেছিলাম। আমি তোমার মতোই বাইরের মানুষ ছিলাম একসময়। রাতে ঘুম আসত না, দুঃস্বপ্নে ভুগতাম। এখানে এসে শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু…”
সে থেমে গেল।
অর্ণব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কিন্তু কী?”
যুবক চোখ নামিয়ে বলল,
“শান্তি পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেই শান্তি ধীরে ধীরে আমাকে বন্দি করে ফেলল। স্বপ্ন আর বাস্তবের পার্থক্য ভুলে গিয়েছি। এখন আমি জানি না আমি আসলে বেঁচে আছি নাকি শুধু ঘুমোচ্ছি।”
অর্ণব শিউরে উঠল।
“তাহলে এখানে সবাই কি এমন?”
যুবক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“হয়তো। কেউ মুখ খোলে না। তবে সবাই জানে—ঘুমপুরে এলে সহজে আর ফেরা যায় না।”
সন্ধ্যাবেলা কুয়াশা আবার ঘন হয়ে উঠল। অর্ণব নিজের কুটিরে ফিরে গেল। জানালার বাইরে চাঁদ উঠেছে, তার আলোয় ভিজে যাচ্ছে গাছপালা।
সে বিছানায় শুয়ে পড়ল, কিন্তু এবার আর ঘুম আসতে চাইছিল না। মন ছটফট করছিল অদিতির জন্য। তার চোখে ভাসছিল অদিতির মায়াময় দৃষ্টি, ঠোঁটের হালকা হাসি।
“আমি কি সত্যিই ওর প্রেমে পড়ছি?”—অর্ণব ভাবল।
“কিন্তু যদি ও শুধু ছায়া হয়? যদি আমি সত্যিই বন্দি হয়ে যাই?”
দ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে হঠাৎ চোখ ভারী হয়ে এল।
অর্ণব আবার স্বপ্নের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ এবার আরও উজ্জ্বল, তারাগুলো যেন কাছে ঝুঁকে পড়েছে। নদীর জল স্রোত বেয়ে টলমল করছে।
অদিতি দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানেই।
আজ তার চোখে বিষণ্নতা।
“অর্ণব, তুমি আমার কাছে কেন আসতে চাও?”
অর্ণব থমকে গেল।
“কারণ তুমি আমাকে শান্তি দাও। আমি বহু বছর ঘুমোতে পারিনি। তোমার সঙ্গেই প্রথমবার আমি ঘুম পেলাম।”
অদিতি মৃদু হেসে বলল,
“শান্তি সবসময় মুক্তি নয়।”
অর্ণব তার দিকে এগিয়ে গেল।
“কিন্তু তুমি… তুমি কি আমাকে সত্যিই চাও?”
অদিতি কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তারপর ধীরে ধীরে হাত বাড়াল।
“আমি তোমাকে চাই, অর্ণব। কিন্তু আমার জগত তোমাকে গ্রাস করতে পারে।”
অর্ণব তার হাত ধরল। মুহূর্তেই এক ঝড় বয়ে গেল চারপাশে। বাতাস কেঁপে উঠল, আকাশে বজ্রপাত। অদিতির মুখে আতঙ্কের ছায়া।
“না, তুমি বুঝতে পারছ না!”—সে চিৎকার করে উঠল।
“আমার জগত তোমাকে জাগতে দেবে না। তুমি যদি আমাকে গ্রহণ করো, তুমি ফিরে যেতে পারবে না!”
অর্ণব তার চোখে চোখ রাখল।
“আমি কোথাও ফিরতে চাই না, অদিতি। আমি শুধু তোমার কাছে থাকতে চাই।”
হঠাৎই চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। অর্ণব বুঝল না কী ঘটছে।
দূরে আবার সেই বৃদ্ধার কণ্ঠ শোনা গেল—
“পিছু হটো, ছেলে! ছায়ার প্রেমে গেলে আর মুক্তি নেই!”
অর্ণব টলমল করে দাঁড়িয়ে রইল। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব জমে উঠছে—
সে কি জাগতে চায়? নাকি অদিতির ঘুমের ভেতর ডুবে যেতে চায়?
অদিতি ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি যদি থেকেও যাও, আমি তোমাকে বাঁচাতে পারব না।”
অর্ণবের চোখে জল ভরে উঠল।
“কিন্তু আমি তো তোমাকে ছাড়া বাঁচতেও চাই না।”
আকাশ কাঁপল। বজ্রপাত ভেঙে পড়ল চারপাশে।
আর অর্ণব বুঝতে পারল—ঘুমপুরের ঘুম তাকে গভীরতর অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
পর্ব -৫
ভোর হবার আগেই অর্ণব ঘুম ভেঙে উঠে বসলো। তার বুক ধড়ফড় করছে। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। স্বপ্নে অদিতি তাকে যে সতর্কবাণী দিয়েছিল, সেই শব্দগুলো এখনও কানে বাজছে—
“আমার জগত তোমাকে জাগতে দেবে না।”
সে জানালার বাইরে তাকাল। চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা। গ্রামের কুটিরগুলো একে একে দৃশ্যমান হচ্ছে, কিন্তু মানুষের উপস্থিতি নেই। পাখির ডাক নেই, শিশুরা খেলছে না। যেন পুরো গ্রাম এক গভীর ঘুমে ডুবে আছে।
অর্ণব বুঝতে পারল—এখানে কিছু লুকোনো রহস্য আছে। অদিতি হয়তো তার অংশ, কিন্তু এর পেছনে আরও অন্ধকার কিছু লুকিয়ে আছে।
অর্ণব বেরিয়ে এল কুটির থেকে। বটগাছটার নিচে এসে দেখল গতকালের সেই যুবক বসে আছে। তার চোখ আরও লালচে, মুখে গভীর ক্লান্তি।
অর্ণব ধীরে ধীরে তার পাশে বসে বলল—
“আমি উত্তর খুঁজতে চাই। তুমি যদি জানো, দয়া করে আমাকে বলো।”
যুবক তাকাল আকাশের দিকে। কণ্ঠে ভাঙা সুর—
“তুমি কি সত্যিই জানতে চাও? উত্তর জানলে তুমি হয়তো আর ফিরতে পারবে না।”
অর্ণব দৃঢ় গলায় বলল—
“আমি তাও জানতে চাই।”
যুবক ফিসফিস করে বলল—
“ঘুমপুরের মাঝখানে আছে এক আয়না। কেউ তাকে ‘অতল আয়না’ বলে। সেই আয়নায় যে একবার নিজের ছায়া দেখবে, তার আর জাগরণ থাকবে না। সেই আয়নার ভেতরেই ঘুমপুরের সত্যি লুকানো আছে।”
অর্ণব শিউরে উঠল।
“অদিতি… সে কি এই আয়নার সঙ্গে জড়িত?”
যুবক চোখ নামিয়ে নিল।
“হয়তো। কিংবা ও নিজেই সেই আয়নার প্রতিফলন।”
রাত হলে আবার স্বপ্ন এলো। অর্ণব এবার দেখল অদিতি নদীর তীরে বসে আছে। তার চুল ভিজে গেছে, মুখে অদ্ভুত বিষণ্নতা।
অর্ণব কাছে গিয়ে বলল—
“অদিতি, তুমি আমাকে কেন দূরে সরাও? তুমি কি সত্যিই আয়নার অংশ?”
অদিতি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ভাঙা গলায় বলল—
“আমি একসময় মানুষ ছিলাম, অর্ণব। এই গ্রামেরই মেয়ে। অজান্তেই সেই আয়নার দিকে তাকিয়ে ফেলেছিলাম। সেই দিন থেকে আমি ছায়া হয়ে গেছি।”
অর্ণব স্তব্ধ।
“তাহলে তুমি মৃত?”
অদিতি চোখে জল নিয়ে মাথা নাড়ল।
“মৃত নই, আবার জীবিতও নই। আমি ঘুমপুরের বন্দিনী। আমি চাই না তুমি আমার মতো হও।”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল।
“কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
অদিতি কাঁদতে কাঁদতে তার হাত ধরল।
“ভালোবাসা এখানে শাপ হয়ে যায়। যদি তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো, তবে আয়নার পথ থেকে সরে দাঁড়াও।”
পরের দিন অর্ণব সিদ্ধান্ত নিল—সে নিজেই খুঁজবে আয়না। গ্রামজুড়ে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছল গ্রামের একদম কেন্দ্রে। সেখানে একটা ভাঙা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
মন্দিরের ভিতরে অদ্ভুত আলো জ্বলছে। দেয়ালে শ্যাওলা, আর মাঝখানে একটা বিশাল কালো আয়না দাঁড়িয়ে আছে। আয়নাটা অস্বাভাবিকভাবে চকচক করছে, যেন ভেতরে অন্য এক জগতের দরজা।
অর্ণব কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার নিজের প্রতিফলন দেখা গেল না। বরং দেখা গেল—অদিতি।
অদিতি আয়নার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে বলল—
“অর্ণব, এসো না। এই আয়না তোমাকে আমার মতো করে দেবে।”
অর্ণব দ্বিধায় পড়ে গেল। সে একদিকে ভয় পাচ্ছে, অন্যদিকে অদিতিকে ছেড়ে যেতে চাইছে না।
ঠিক তখনই পেছন থেকে অনেক কণ্ঠস্বর শোনা গেল। অর্ণব ঘুরে দেখল—পুরো গ্রামের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ যন্ত্রণা।
এক বৃদ্ধা সামনে এগিয়ে এল—সেই বৃদ্ধাই, যাকে অর্ণব প্রথম রাতে দেখেছিল।
সে বলল—
“তুমি যদি আয়নায় তাকাও, তুমি আমাদের মতো হয়ে যাবে। আমরা সবাই একদিন বাইরের মানুষ ছিলাম। কেউ ঘুম খুঁজতে এসেছিল, কেউ ভালোবাসা, কেউ মুক্তি। কিন্তু শেষমেশ সবাই ছায়া হয়ে গেছি।”
অর্ণব কেঁপে উঠল।
“তাহলে আমি কি ফাঁদে পড়েছি?”
বৃদ্ধা দুঃখভরা কণ্ঠে বলল—
“হ্যাঁ। তবে তোমার হাতে এখনও সময় আছে। তুমি চাইলে এখান থেকে পালাতে পারবে।”
অর্ণব হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সামনে আয়নার ভেতরে অদিতি, পিছনে পুরো গ্রামবাসীর ফাঁকা চোখ। আর তার নিজের বুকের ভেতর জ্বলছে দ্বন্দ্ব—
সে কি সত্যিই পালাতে পারবে, নাকি অদিতির ছায়ায় ডুবে যাবে?
পর্ব-৬
অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে অতল আয়নার সামনে। একপাশে অদিতির চোখ ভিজে উঠছে, সে কাঁপা কণ্ঠে ডেকে চলেছে—
“এসো না, অর্ণব… আমি চাই না তুমিও আমার মতো হয়ে যাও।”
অন্যপাশে বৃদ্ধা আর গ্রামের মানুষগুলো, তাদের ফাঁকা চোখে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। তারা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে, যেন তার ভাগ্য নির্ধারণ হতে চলেছে।
অর্ণবের বুক ধড়ফড় করছে। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব—
সে কি সত্যিই পালাবে? নাকি অদিতির হাত ধরে অজানার ভেতরে পা বাড়াবে?
অবশেষে অর্ণব এক পা এগিয়ে গেল। আয়নার ওপর কুয়াশার মতো আলো জমে উঠল। সে চমকে দেখল—আয়নায় নিজের প্রতিফলন নেই, বরং ভেসে উঠছে অদ্ভুত সব দৃশ্য।
একটা নদী, যেটা চাঁদের আলোয় রুপালি হয়ে বয়ে যাচ্ছে। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ, কারো চোখে জল, কারো ঠোঁটে অচেনা হাসি। তারা সবাই যেন অপেক্ষা করছে কারও জন্য।
হঠাৎ সেই ভিড়ের ভেতর থেকে অদিতির প্রতিচ্ছবি উঠে এলো। সে হাত বাড়িয়ে বলল—
“এখানে এলে তুমি আর কখনো একা হবে না। আমি তোমার সঙ্গে থাকব, প্রতিটি স্বপ্নে, প্রতিটি নিশ্বাসে।”
অর্ণবের শরীর কেঁপে উঠল। ভালোবাসার এমন আকর্ষণ সে জীবনে কোনোদিন পায়নি।
ঠিক তখনই পেছন থেকে সেই বৃদ্ধার কণ্ঠ ছুটে এলো—
“না, ছেলে! ও আলোয় মায়া আছে, মুক্তি নেই। আমরাও একদিন এমন আলো দেখে ডুবেছিলাম। দেখো আমাদের চোখে—আমরা কি বেঁচে আছি? না, আমরা শুধু ঘুমের খাঁচায় বন্দি।”
অর্ণব ঘুরে তাকাল। গ্রামের লোকদের মুখে অসহায় কান্না।
একজন যুবক ফিসফিস করে বলল—
“আমি একসময় কবি ছিলাম। লিখতে লিখতে ঘুম হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখানে এসে ভেবেছিলাম শান্তি পাবো। কিন্তু এখন আমি শুধু ছায়া, শব্দও আর আমার নিজের নয়।”
অন্য একজন মেয়ের মুখে অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু চোখে শূন্যতা।
“আমি ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন ভালোবাসা আমার কাছে শুধু এক ঠান্ডা স্মৃতি।”
অর্ণব ভয়ে কেঁপে উঠল।
আয়নার ভেতর অদিতি হঠাৎ কেঁদে ফেলল।
“আমি জানি, তারা সত্য বলছে। আমি জানি এই আয়নার ভেতর আসা মানেই মৃত্যুর মতো এক ঘুম। কিন্তু অর্ণব, আমি তো আর কিছুই নই… শুধু এক স্মৃতি, এক ছায়া। যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও, আমি চিরকাল একা হয়ে যাব।”
তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে আয়নার পাটে পড়ল, আর আয়নাটা যেন ঢেউ খেলল।
অর্ণবের বুক ফেটে যাচ্ছিল।
সে বুঝতে পারছিল—অদিতির প্রেম সত্যি, কিন্তু তার জগত মৃত্যু আর ঘুমের জগত।
অদিতি হাত বাড়িয়ে দিল।
অর্ণব দ্বিধা নিয়ে হাত বাড়াল। মুহূর্তেই আয়নার পৃষ্ঠ ভেঙে গেল তরঙ্গের মতো। ঠান্ডা একটা স্রোত তার আঙুল ছুঁয়ে গেল।
সেই স্পর্শে তার মাথার ভেতর কেমন আলো ভরে উঠল। সে দেখতে পেল—অদিতি তার সঙ্গে হাঁটছে নদীর ধারে, তারা দুজনে মিলে গান গাইছে, হাসছে, এক অদ্ভুত স্বপ্নময় জীবনে ডুবে যাচ্ছে।
কিন্তু সেই একই সঙ্গে ভেসে উঠল অন্য এক ছবি—
অর্ণব বিছানায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে, বাইরের পৃথিবীতে তার শরীর নিস্তব্ধ, কেউ তাকে জাগাতে পারছে না।
অর্ণব হঠাৎ হাত সরিয়ে নিল। আয়না কেঁপে উঠল, অদিতির মুখে যন্ত্রণা ভরে উঠল।
“কেন? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?”—অদিতি কাঁদতে কাঁদতে বলল।
অর্ণব কষ্টে ফিসফিস করল—
“ভালোবাসি। তাই তো তোমার সঙ্গে ডুবে যেতে চাই। কিন্তু আমি যদি এখানেই হারিয়ে যাই, আমার ভালোবাসা তো শুধু স্বপ্ন হয়ে থাকবে। আমি চাই তোমাকে সত্যি মুক্ত করতে, অদিতি।”
অদিতি হতবাক হয়ে গেল।
“আমাকে মুক্ত করবে? কিন্তু আমি তো বন্দি ছায়া, আমার মুক্তি নেই।”
অর্ণব দৃঢ় গলায় বলল—
“আছে। প্রতিটি ছায়ারই মুক্তি আছে, শুধু সেই দরজাটা খুঁজে বের করতে হবে।”
হঠাৎ আয়না তীব্রভাবে কাঁপতে শুরু করল। কালো আলো বেরিয়ে এলো, চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। গ্রামবাসীরা আতঙ্কে পিছিয়ে গেল।
আয়নার ভেতর থেকে শোনা গেল গর্জন—
“যে ছায়াকে মুক্ত করতে চায়, সে নিজেই চিরকালীন ঘুমে হারিয়ে যাবে।”
অর্ণব দাঁত চেপে বলল—
“আমি ভয় পাই না। যদি ঘুমেই হারাতে হয়, তবু অদিতিকে মুক্ত না করে ফিরব না।”
অদিতির চোখে বিস্ময়।
“অর্ণব, তুমি কি সত্যিই নিজের জীবন আমার জন্য ত্যাগ করবে?”
অর্ণব উত্তর দিল না। শুধু আয়নার ভেতরের অন্ধকারে পা বাড়াল।
আয়নার আলো তাকে গ্রাস করল।
গ্রামবাসীরা আতঙ্কে চিৎকার করল।
আর অদিতির চোখে একসাথে ভয় আর আশার ঝিলিক জ্বলে উঠল।
অর্ণব প্রবেশ করল আয়নার ভেতরের জগতে।
পর্ব -৭
অর্ণব যখন আয়নার ভেতরে পা রাখল, তার চারপাশ মুহূর্তেই বদলে গেল। যেন মাটির নিচ থেকে আলো উঠে এসে তাকে ঘিরে ধরল। শরীর ভেসে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে মনে হচ্ছে সে আর পৃথিবীর মানুষ নয়—এক অচেনা স্বপ্নের সন্তান।
আলো মুছে গেলে সে নিজেকে দেখতে পেল এক নদীর ধারে। সেই নদী ঠিক যেমনটা সে স্বপ্নে দেখত—চাঁদের আলোয় রুপালি ঢেউ খেলছে, আর বাতাসে অদ্ভুত শান্তি। চারপাশে অসংখ্য ফুল, যেগুলো রাতের আঁধারেও আলো ছড়াচ্ছে।
দূরে দাঁড়িয়ে আছে অদিতি। তার চুল বাতাসে ভেসে যাচ্ছে, মুখে এক অচেনা হাসি।
“অবশেষে তুমি এলে, অর্ণব।”
অর্ণব দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।
তার বুক কেঁপে উঠল—“তুমি তো সত্যিই আছো…”
অদিতি মৃদু স্বরে বলল—
“হ্যাঁ, আমি আছি। কিন্তু এই ‘আছে’-এর মানে তুমি হয়তো জানো না।”
অর্ণব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল।
“মানে?”
অদিতি হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল নদীর জলে। জল যেন কাঁচের মতো স্বচ্ছ, অথচ ভেতরে অসংখ্য প্রতিচ্ছবি। অর্ণব চমকে দেখল—ভেতরে ভেসে আছে মানুষ। কেউ গান গাইছে, কেউ কাঁদছে, কেউ ভালোবাসার টানে হাত বাড়াচ্ছে।
অদিতি বলল—
“এরা সবাই একসময় বাইরের পৃথিবীর মানুষ ছিল। তারা এখানে এসেছে ঘুম খুঁজতে, শান্তি পেতে, ভালোবাসার আশায়। আর এখন তারা এই নদীর ভেতর বন্দি।”
অর্ণব হতভম্ব।
“মানে… এরা সবাই মৃত?”
অদিতি মাথা নাড়ল।
“না, মৃত নয়। তাদের শরীর বাইরের পৃথিবীতে শুয়ে আছে, নিস্তব্ধ, জাগতে অক্ষম। কিন্তু তাদের আত্মা চিরতরে এই জলে আটকে গেছে।”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল।
“তাহলে আমি?”
অদিতি তার চোখে চোখ রেখে বলল—
“তুমি চাইলে আমার সঙ্গে থাকতে পারো। প্রতিটি রাতে আমরা একে অপরকে পাবো, প্রতিটি মুহূর্ত হবে স্বপ্নের মতো। কিন্তু এর বিনিময়ে তুমি বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।”
অর্ণব চুপ করে রইল। তার মনে পড়ল মায়ের মুখ, বন্ধুদের ডাক, তার অসম্পূর্ণ লেখা আর অপূর্ণ স্বপ্নগুলো। আবার অন্যদিকে অদিতির কোমল হাত, তার চোখের মায়া, সেই অদ্ভুত ভালোবাসার ঢেউ।
সে ফিসফিস করে বলল—
“তাহলে এখানে থাকা মানে মৃত্যু নয়, কিন্তু পুরোপুরি জীবনও নয়।”
অদিতি কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ। আমি এভাবেই আছি এত বছর। আমি চাই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও, অর্ণব। কিন্তু আমি জানি, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতেও পারব না।”
অর্ণব দ্বিধায় পড়ে গেল।
ভালোবাসা আর মুক্তির টানাপোড়েনে তার ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ নদীর জল কেঁপে উঠল। স্রোতের ভেতর থেকে উঠল এক বিশাল ছায়া-আকৃতি। কালো চোখ, হাতে লম্বা দণ্ড।
সে গর্জন করে বলল—
“কোনো মানুষ এখানে স্বেচ্ছায় ঢুকে বাঁচতে পারে না। এ জগতের প্রতিটি পদক্ষেপের শর্ত আছে। তুমি যদি অদিতির পাশে থাকতে চাও, তবে তোমাকেও এই নদীর ভেতর ডুব দিতে হবে।”
অর্ণব আতঙ্কে পিছিয়ে গেল।
“ডুব মানে? আমি কি চিরকাল বন্দি হয়ে যাব?”
ছায়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল—
“হ্যাঁ। বাইরের দুনিয়ার কোনো আলো তোমাকে ছুঁতে পারবে না।”
অদিতি কাঁদতে কাঁদতে অর্ণবের হাত চেপে ধরল।
“না, তুমি পারবে না… আমি চাই না তুমি আমার মতো হও।”
ঠিক তখনই আকাশ ফেটে এক ঝলক আলো পড়ল নদীর ওপর।
অর্ণব বিস্ময়ে দেখল—আলোতে অসংখ্য ছায়া কেঁপে উঠছে, যেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছে।
তার বুকের ভেতর হঠাৎ শব্দ উঠল—
“হয়তো এই আলোর ভেতরেই আছে মুক্তির পথ।”
সে চোখ বন্ধ করে শপথ করল—
“আমি অদিতিকে বন্দি রেখে যাব না। যদি ছায়াদের মুক্ত করার কোনো উপায় থাকে, আমি তা খুঁজে বের করব।”
অদিতি বিস্মিত হয়ে তাকাল।
“তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর, মুক্তি সম্ভব?”
অর্ণব দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“বিশ্বাস করি। কারণ ভালোবাসা যদি শুধু বাঁধন হয়, তবে সেটা সত্যি ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা মানে মুক্তি।”
আকাশ মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। নদীর জল উথালপাথাল। আয়নার রক্ষক গর্জন করে উঠল—
“তুমি যদি এই নিয়ম ভাঙতে চাও, তবে পুরো ঘুমপুর ধ্বংস হয়ে যাবে!”
অর্ণব দাঁত চেপে বলল—
“তাহলে ধ্বংস হোক। কিন্তু আমি অদিতিকে এই অনন্ত ঘুমে ডুবতে দেব না।”
অদিতির চোখে ভয় আর প্রেম একসাথে ঝলসে উঠল।
চারদিক কাঁপতে শুরু করল, আয়নার জগত যেন ভেঙে পড়ছে।
অর্ণব বুঝতে পারল—তার সামনে আসছে সবচেয়ে বড় লড়াই।
পর্ব - ৮
নদীর ঢেউ একে একে আছড়ে পড়ছে আয়নার জগতের তীরে। আকাশ কালো হয়ে গেছে, বিদ্যুতের ঝলকানি ভয়ানক ছায়া ছড়াচ্ছে চারদিকে। অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে অদিতির পাশে, অথচ চারপাশে মৃত্যুর মতো আতঙ্ক।
কালো ছায়া-আকৃতি এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে শুধু রক্ষক নয়—অভিশাপের প্রতীক। তার চোখে আগুনের মতো লাল আভা, হাতে বিশাল দণ্ড।
সে গর্জন করে বলল—
“মানুষ! তুমি নিয়ম ভাঙতে চলেছ। যে ছায়া একবার আয়নায় বন্দি হয়েছে, তার মুক্তি নেই। যদি তুমি চেষ্টা করো, তবে তোমাকেও এই নদীর গর্ভে গ্রাস করতে হবে।”
অর্ণব বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।
“আমি ভয় পাই না। যদি অদিতি বন্দি হয়, তবে আমি মুক্তি না দিয়ে ফিরব না।”
অদিতি আতঙ্কে কেঁপে উঠল।
“না অর্ণব, তুমি বুঝতে পারছ না—এ লড়াই কেউ জেতেনি কোনোদিন!”
আয়নার রক্ষক দণ্ড তুলে ধরল। মুহূর্তে চারদিক থেকে কালো তরঙ্গ উঠে এসে অর্ণবকে ঘিরে ফেলল। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শরীর যেন পাথরের মতো ভারী।
কিন্তু ঠিক তখনই অদ্ভুত কিছু ঘটল। অর্ণবের বুক থেকে আলো বেরোতে লাগল—সাদা আলো, যা অন্ধকার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে।
অদিতি অবাক হয়ে ফিসফিস করল—
“এই আলো… এটা তোমার ভালোবাসা।”
রক্ষক কেঁপে উঠল।
“না! কোনো মানুষের ভালোবাসা এত শক্তিশালী হতে পারে না।”
অর্ণব দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করল। মনে মনে শুধু বলল—
“আমি অদিতিকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসা মানে বাঁধন নয়, মুক্তি।”
আলোর স্রোত ছুটে গেল নদীর ভেতরে। নদীর ভেতর যেসব ছায়া বন্দি ছিল, তারা একে একে আলোয় ঝলসে উঠল, যেন মুক্তির আশায় কেঁপে উঠছে।
আলো ছড়িয়ে পড়তেই অদিতির দেহ বদলে যেতে লাগল। তার ছায়াময় শরীর ঝলসে উঠল, মুখের বিষণ্নতা ভেঙে গেল। সে ধীরে ধীরে আগের মতো স্বাভাবিক রূপে ফিরতে লাগল—একজন মেয়ে, যার চোখে আবার জীবন ফুটে উঠছে।
অদিতি বিস্ময়ে ফিসফিস করল—
“অর্ণব… তুমি পেরেছ… আমার শাপ ভেঙে গেছে!”
কিন্তু ঠিক তখনই নদী প্রচণ্ড গর্জে উঠল। আয়নার রক্ষক চিৎকার করে উঠল—
“না! নিয়ম কেউ ভাঙতে পারবে না! এই মুক্তির বিনিময়ে কিছু দিতে হবে।”
আকাশ কেঁপে উঠল। রক্ষক দণ্ড মাটিতে আঘাত করতেই শব্দ ভেসে এলো—
“যে মুক্তি দিল, তাকেই ঘুমপুরের শপথ নিতে হবে। কেউ শপথ ভাঙতে পারে না।”
অর্ণব হতভম্ব।
“মানে কী?”
রক্ষক গর্জন করে বলল—
“অদিতি মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু তার জায়গা পূরণ করতে হবে। তোমাকে থাকতে হবে এখানে, অর্ণব। তুমি হবে নতুন রক্ষক।”
অদিতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
“না! আমি এটা হতে দেব না। সে আমার জন্য এত ত্যাগ করল, এবার আমি ওকে হারাতে চাই না।”
অর্ণব চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ভেতরে বুঝল—এই নিয়ম সত্যিই ভাঙা যায় না। অদিতি মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে তাকে মূল্য দিতে হবে।
অদিতি কাঁদতে কাঁদতে অর্ণবের বুকে মাথা রাখল।
“আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, অর্ণব। কিন্তু যদি এর মানে হয় তোমার চিরকালের বন্দিত্ব, তবে আমি এই মুক্তি চাই না। আমি আবার বন্দি হব, তবুও তুমি থেকো।”
অর্ণব তার মুখ তুলে ধরে মৃদু হাসল।
“না অদিতি, তুমি যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছ। আমি চাই তুমি আলোয় ফিরে যাও। আমার জন্য কেঁদো না।”
তার কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
“কেউ না কেউ তো এই আয়নার শপথ বহন করবে। যদি আমি তা না করি, তবে আর কে?”
আলো চারপাশ ভরিয়ে দিল। অদিতি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের জগতের দিকে চলে গেল। তার শরীর একে একে আয়নার ভেতর থেকে মুছে গিয়ে বাইরের পৃথিবীতে ফুটে উঠল।
অর্ণব শেষবারের মতো তাকাল তার দিকে। অদিতির চোখে শুধু অশ্রু আর কৃতজ্ঞতা।
রক্ষক ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর তার জায়গায় দাঁড়াল অর্ণব। তার চোখে আর মানুষ নেই—শুধু অদম্য আলো, যার ভেতরে আছে ঘুমপুরের নতুন শপথ।
অদিতি মুক্তি পেল।
কিন্তু অর্ণব রইল আয়নার বন্দি—নতুন রক্ষক হিসেবে।
ঘুমপুর আবার নীরব হলো। কিন্তু এবার ছায়াদের ভেতর এক নতুন ফিসফিসানি—
“একজন মানুষ ভালোবাসা দিয়ে নিয়ম ভেঙেছে।”
পর্ব -৯
ভোরের প্রথম আলো যখন নদীর ধারে ঝলমল করে উঠল, অদিতি হঠাৎ নিজের শরীরে উষ্ণতা অনুভব করল। অনেক দিন পর সে বাতাসের গন্ধ পেল, আঙুলের ফাঁকে সূর্যের আলো পড়ল। যেন মৃত্যুর অন্ধকার থেকে হঠাৎ জীবনের ভেতর ফিরে এসেছে।
কিন্তু শরীর হালকা হলেও তার বুক ভরে উঠল শূন্যতায়। কারণ, তার পাশে দাঁড়িয়ে নেই অর্ণব।
“অর্ণব…” অদিতি কাঁপা গলায় ডাক দিল, কিন্তু নদী শুধু ঢেউয়ের শব্দ ফিরিয়ে দিল।
অদিতি চারদিকে তাকাল। নদীর ভেতরে ঝলসানো আলো নিভে গেছে। আর কোনো রক্ষকের ছায়া নেই। শুধু আয়না-ঝলমলে জল, যেটার ভেতরে কখনো অর্ণবের মুখ ছিল, আজ নেই।
সে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মাটিতে। অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল, তার গলা ফেটে চিৎকার বেরোল—
“তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে, কিন্তু তুমি নিজেই হারালে… কেন অর্ণব? কেন?”
পাশের গাছের ডালে পাখি ডাকছিল, সূর্য উঠছিল ধীরে ধীরে, অথচ অদিতির পৃথিবী অন্ধকারেই ডুবে রইল।
ঘুমপুরের মানুষজন সকালের বাজারে যাচ্ছিল। তারা হঠাৎ অদিতিকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
“এই মেয়েটা তো…? এ কি সত্যিই ফিরল?”
“এ যে কয়েক মাস আগে হঠাৎ গায়েব হয়েছিল!”
কেউ বিশ্বাস করল না, কেউ ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল। আবার কেউ বলল—
“হয়তো কোনো অলৌকিক ঘটনার শিকার ছিল। কিন্তু ফিরল কীভাবে?”
অদিতি উত্তর দিল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখে যেন অর্ণবের ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ওদিকে, আয়নার ভেতরে অর্ণব নতুন রূপে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সেই দণ্ড, যেটা আগে রক্ষকের ছিল। চারপাশে কালো ঢেউ থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে শপথের ভার।
রক্ষকের কণ্ঠ যেন আকাশ থেকে ভেসে এল—
“এবার থেকে তুমিই আয়নার পাহারাদার। ছায়াদের মুক্তি দিতে চাইলে, তোমার ভালোবাসার আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে।”
অর্ণব নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
মনের ভেতরে একটাই কথা—
“অদিতি যেন সুখে থাকে। আমি থাকব এখানে, তার স্মৃতির সাথেই।”
দিন কেটে গেল। অদিতি গ্রামে ফিরল ঠিকই, কিন্তু সে আর আগের মতো হলো না। মানুষের ভিড়েও সে একা, হাসির মাঝে তার চোখে অশ্রু লুকিয়ে থাকে।
রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলে—
“অর্ণব, তুমি কোথায়? আমি কি তোমাকে আবার দেখতে পাব?”
কখনো সে নদীর ধারে যায়, আয়নার ভেতর তাকায়, হয়তো ছায়ার আড়ালে অর্ণবকে এক ঝলক দেখতে পাবে বলে। কিন্তু জল শুধু নীরব।
এক রাতে, অদিতি নদীর ধারে দাঁড়িয়েছিল। বাতাসে অদ্ভুত কাঁপুনি এল। জলের ঢেউ একেবারে শান্ত হয়ে গেল।
হঠাৎ সে শুনল এক ফিসফিসানি—
“অদিতি…”
শব্দটা খুব ক্ষীণ, কিন্তু সে বুঝল—এ অর্ণবের কণ্ঠ।
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
“অর্ণব! তুমি কি আমায় শুনতে পাচ্ছ?”
আয়নার ভেতরে আলোর ঝলকানি দেখা দিল এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু তারপরই সব নিভে গেল।
অদিতি হাঁটু মুড়ে বসে কেঁদে ফেলল।
সে জানল—অর্ণব বেঁচে আছে, কিন্তু বন্দি।
অদিতি তখন সিদ্ধান্ত নিল।
সে শুধু কাঁদবে না। সে অর্ণবকে ফেরানোর পথ খুঁজবে।
গ্রামের বয়স্করা বলে—আয়নার শাপ ভাঙতে হলে ‘ঘুমপুরের সপ্ত রহস্য’ জানতে হবে।
কেউ জানে না সেগুলো কোথায়।
কেউ জানে না আসলে এগুলো সত্যি কিনা।
কিন্তু অদিতির চোখে দৃঢ়তা।
“আমি যদি অর্ণবকে ফেরাতে চাই, তবে আমাকেই এই রহস্য খুঁজতে হবে।”
আকাশের দিকে তাকিয়ে সে মৃদুস্বরে বলল—
“অর্ণব, অপেক্ষা করো। এবার আমি তোমার জন্য লড়ব।”
পর্ব -১০
অদিতি একা বসেছিল গ্রামের পুরোনো বটগাছের তলায়। সেদিন পূর্ণিমার আলোয় চারপাশ ভিজে ছিল রূপালি আভায়। সে জানত—যদি কাউকে সত্যি জানতে হয়, তবে যেতে হবে গ্রাম্য প্রবীণদের কাছে।
পরদিন সকালেই সে গেল হরিপদ কাকুর কাছে। হরিপদ ছিলেন গ্রাম্য কাহিনিকার, প্রায় নব্বই ছুঁইছুঁই বয়স। তাঁর চোখ ধূসর, কণ্ঠস্বর ফিসফিসের মতো ক্ষীণ, অথচ গল্পের ভেতরে অদ্ভুত শক্তি।
অদিতি হাঁটু মুড়ে বসল তাঁর সামনে।
“কাকু, আপনি কি জানেন ঘুমপুরের সপ্ত রহস্যের কথা? অর্ণবকে ফেরাতে আমাকে ওগুলো খুঁজে পেতেই হবে।”
হরিপদ কাকু ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলেন, যেন বহুদিনের ঘুম ভাঙল।
“সপ্ত রহস্য? হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু ওগুলো কেবল গল্প নয়, অভিশাপের বীজ।”
হরিপদ কাকু কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন—
“ঘুমপুর একদিন সাধনার স্থান ছিল। সাতজন সাধক এখানে ধ্যান করতেন। তাঁদের অমর শক্তি ভেঙে সাতটি রহস্যে রূপ নিয়েছিল।
প্রথম রহস্য: স্বপ্নফুল, যে কেবল অশ্রুজলে ফোটে।
দ্বিতীয়: অমাবস্যার ঘণ্টা, বাজলেই সময় থেমে যায়।
তৃতীয়:- রক্ত চোখের নদী
চতুর্থ: অলীক সিঁড়ি, যা নিয়ে যায় নিষিদ্ধ আকাশে।
পঞ্চম: স্মৃতির পালক, যেখানে প্রতিটি স্মৃতি একেকটি আত্মার স্মৃতি।
ষষ্ঠ: শূন্যবীণা, যার সুর শোনে শুধু মৃতেরা।
সপ্তম: অদৃশ্য শিলা, যা ধরে রাখে নদীর বাঁধন।
অদিতি নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল। মনে হচ্ছিল প্রতিটি শব্দ তার বুকের ভেতর খোদাই হচ্ছে।
ওদিকে আয়নার ভেতরে অর্ণবের প্রথম পরীক্ষা শুরু হলো। নদীর তলদেশ হঠাৎ কাঁপতে লাগল, জলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল শত শত ছায়া। তাদের চোখ লাল, মুখ বিকৃত, আর তারা সবাই একসাথে চিৎকার করছে—
“আমাদের মুক্তি দাও!”
অর্ণব বুঝল, এ শুধু পরীক্ষা নয়—তার ইচ্ছাশক্তির লড়াই।
সে চোখ বন্ধ করে কণ্ঠে বলল—
“আমি একা নই। অদিতি আছে। আমি ওকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।”
তার বুক থেকে আবার আলো ছড়াল। ছায়ারা একে একে শান্ত হলো, নদীর ভেতরে মিলিয়ে গেল। কিন্তু আলো নিভতেই অর্ণব ক্লান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এক অদৃশ্য কণ্ঠ তখন ফিসফিস করে বলল—
“এ তো শুধু শুরু।”
হরিপদ কাকুর গল্প শোনার পর অদিতি মাথা তুলল।
“তাহলে আমাকে প্রথমে স্বপ্নফুল খুঁজতে হবে।”
কাকু মৃদু হাসলেন।
“স্বপ্নফুল সহজ নয়, মেয়ে। তা ফোটে কেবল মানুষের অশ্রুজলে। এবং সেটা ধরে রাখতে পারে কেবল সে-ই, যার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ।”
অদিতি দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“আমি অর্ণবকে ভালোবাসি, আর তার জন্য কিছুতেই পিছিয়ে যাব না।”
হরিপদ কাকুর চোখে জল চিকচিক করল।
“তাহলে যাও, মেয়ে। তোমার পথ কণ্টকাকীর্ণ। কিন্তু মনে রেখো, সত্য ভালোবাসা কখনো হারে না।”
অদিতি সেদিন রাতে নদীর ধারে গেল। হাতে কেবল একটি মাটির প্রদীপ। আয়নার জলে তাকিয়ে সে বলল—
“অর্ণব, আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম—আমি তোমাকে ফেরাবো। একে একে সাত রহস্য ভেদ করব।”
তার অশ্রু এক ফোঁটা পড়ল জলে। জলের ভেতরে হঠাৎ অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল। ঢেউয়ের ভেতর মৃদু ভেসে এলো একটি কণ্ঠ—
“আমি অপেক্ষা করছি, অদিতি…”
অদিতি বুঝল—প্রথম পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
চলবে…
@ লেখকের অনুমতি ছাড়া এই গল্পের যেকোনো লাইন কপি করলে বা যেকোনো স্থানে প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের আওতায় পড়বে।
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder