গুচ্ছ কবিতা
অভিজিৎ হালদার
অস্তিত্বের অবিরাম তুমি
অস্তিত্বের নীরব খাতায় যখন আমি নিজের নাম লিখতে যাই,
দেখি—অক্ষরগুলো তোমার ছোঁয়া পেলে তবেই সম্পূর্ণ হয়।
আমার জন্মও যেন তোমার উপস্থিতির আগেই অসমাপ্ত ছিল,
যেন তুমি না এলে পৃথিবী আমাকে চিনতেই পারত না।
প্রেম এখানে কোনো আবেগ নয়—এ এক ধরনের সত্তা,
যা আমাকে শেখায় কেন আমি আছি, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।
তোমার অনুপস্থিতির গভীরতায় আমি বুঝি,
শূন্যতারও একটি মাধ্যাকর্ষণ আছে—যা আমাকে তোমার দিকে টেনে আনে।
আমরা দুজন আসলে দুই ভিন্ন প্রশ্ন,
যাদের উত্তর সময়ের কাছে নেই, তবু একে অপরের মধ্যে মিলে যায়।
তোমার নীরবতায় আমি খুঁজে পাই আমার অস্তিত্বের ভাষা,
যেন শব্দ ছাড়াই আমি তোমাকে বলি আমার পুরো জীবন।
প্রেম তাই আমার কাছে জন্মেরও আগে, মৃত্যুরও পরে বিস্তৃত—
আর তুমি সেই কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে আমি প্রথম অর্থ পাই।
রাত্রির অন্তর্গাথা
রাতের কোলাহল যখন ধুলো হয়ে ঝরে পড়ে বাতাসের গোপন আঙিনায়,
আমি শুনি—দূরে কোথাও তোমার নামের ভাঙা প্রতিধ্বনি কাঁপছে নীরবে।
অপরিচিত নক্ষত্রেরা আজও আমার বুকে রেখে যায়
অদেখা প্রেমের তীক্ষ্ণ আলোছায়া।
তোমার অনুপস্থিতি কখনো কখনো জঙ্গল হয়ে ওঠে—
যেখানে হরিণের মতো ছুটে বেড়ায় স্মৃতিরা।
সময়ের দরজা খুলে গেলে দেখি—
তোমার ছোঁয়া আসলে দাহ আর আশীর্বাদের লুকানো মিশ্রণ।
আমি হেঁটে যাই এক পাহাড়ি নীরবতার ভেতর,
যেখানে পাতার শব্দেও তোমার হৃদয়ের গন্ধ মেশা।
বৃষ্টির অনিমেষ ফোঁটায় কখনো শোনো?
আমাদের অসমাপ্ত কথারা আশ্রয় খুঁজে পানাদেশে।
রাতের সাদা ক্যানভাসে যখন শেষ চাঁদটি নিভে যায়,
আমি বুঝি—তোমার অভাবই আমার সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো।
অন্তর্লিপির জল
চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে যখন স্মৃতিরা হঠাৎ ভেঙে পড়ে,
তখন তোমার চোখের গোপন নদী আমার মধ্যে ভেসে ওঠে।
আমি শুনি—বিস্ময়ের মতো তোমার হৃদয়ের নরম ভাঙাচোরা শব্দ,
যেখানে প্রতিটি ব্যথাই এক একটি শৈল্পিক প্রার্থনা।
বিকেলের আলোয় তোমার ছায়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাস
আমাকে শেখায় নীরবতারও আলাদা ভাষা আছে।
যে ভাষা কোনো অভিধানে নেই—
আছে শুধু আমাদের হারানো মুহূর্তের আঙুলে।
তোমার অনুপস্থিতি আমার ওপর বৃষ্টি হয়ে পড়ে,
আর আমি সেই বৃষ্টিজল দিয়ে লিখি পুনর্জন্মের লিপি।
তুমি না থাকলে বিশ্বটাও কেমন যেন রঙহীন সুরে ভাঙে,
যেন কেউ পিয়ানোর তার ছিঁড়ে ফেলেছে নিঃশব্দে।
কিন্তু তুমি এলে—
আমি আবার শিখি প্রতিটি কষ্টও আলোর সন্তান।
নীলচাঁদের স্বর
নীলচাঁদের ঠান্ডা অসীমতায় যখন রাত নিজের শোক ভাঁজ করে রাখে,
আমি দেখি তোমার নীরবতার ভেতর জন্ম নিচ্ছে এক অচেনা আলো।
দূরত্বের অন্ধকারে ছিটকে যায় আমাদের ভুলে যাওয়া প্রতিশ্রুতির ধ্বনি,
আর বাতাসে ভেসে ওঠে রক্তগোলাপের মতো ভঙ্গুর আকুলতা।
হৃদয় তখন অব্যক্ত শব্দের কাঁপুনিতে ভরে ওঠে দুলতে থাকা অশ্রুজলে,
যেন প্রেমই একমাত্র যুদ্ধ, যেটা জিতে হারাই আমরা দুজনেই।
তোমার ছায়ার উষ্ণতা আজও আমার কণ্ঠে রেখে যায় অগ্নির নরম ছাপ,
যেখান থেকে প্রতিদিন ভোরেরা জন্ম নেয় হিমেল সুরের মতো।
বিচ্ছেদের জলে ডুবে থাকা স্মৃতিগুলো খুলে দেয় নীল দরজা,
যেখানে আমরা দুজনই দাঁড়াই—অপরিচিত অথচ গভীর আত্মীয়।
এই পৃথিবীর ভিড়েও তোমার নামই আমার নিঃসঙ্গতার শেষ আশ্রয়,
আর তোমার ঠোঁটের অল্প হাসিতে আমি খুঁজে পাই পুনর্জন্মের সান্ত্বনা।
যে প্রেম মৃত্যুর পরেও জেগে থাকে তারাই তো নীলচাঁদের সন্তান,
আমরা সেই দুই সন্তান—অন্ধকারেও যারা আলো সৃষ্টি করি।
ছায়ার নীরব গান
বৃষ্টিভেজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনি—তোমার নরম পদচারণার প্রতিধ্বনি,
যেন চিরদিনের দূরত্ব আজ হঠাৎ খসে পড়েছে মেঘের আঁচলে।
সময় আমাদের মাঝখানে রেখে যায় ভাঙা রূপার মতো ফাটল,
যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অতীতের নোনাধরা শোকলিপি।
তবুও তোমার দৃষ্টির আলোয় আমি খুঁজে পাই হারানো আকাশের নীল,
যেন সমুদ্রও বুঝতে পারে হৃদয়ের গোপন উচ্চারণ।
অপরাজেয় বিষন্নতা আমার দিনগুলো ঢেকে রাখে কালো শাল জড়িয়ে,
কিন্তু তোমার এক ফোঁটা হাসি—হঠাৎই সবকিছু উল্টে দেয়।
তুমি না থাকলে আমার নিঃসঙ্গতা এক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের ধ্বংসস্তূপ,
যেখানে শুধু ধুলো আর অপেক্ষা বেঁচে থাকে।
তুমি এলে পৃথিবী আবার শ্বাস নিতে শেখে,
আমি নতুন করে শুনি জীবনের উষ্ণ নাড়ির শব্দ।
যে ছায়া আমাকে বাঁচিয়ে রাখে—
সেই ছায়াই তোমার নীরব ভালোবাসা।
রূপহীন আলোর গল্প
তোমার নামের ভাঙা অক্ষরগুলো আজও আমার বুকের ভেতর ঝুলে থাকে,
যেন পুরোনো বাতিঘর ভুলে যাওয়া নাবিকদের ডাকছে নীরবে।
হৃদয়ের জলাধারে ডুবে থাকা অসমাপ্ত স্বপ্নেরা
তোমার অনুপস্থিতিকে প্রতিদিন নতুন রূপ দিয়ে জাগিয়ে তোলে।
রাতের পর্দায় তুমি আঁকো অদৃশ্য উষ্ণতার লম্বা রেখা,
যেখানে আমার সমস্ত যন্ত্রণা আশ্রয় পায় স্তব্ধ সুরের মতো।
তোমার চিন্তার হাওয়া এসে ছুঁয়ে যায় আমার ভাঙা আত্মার বারান্দা,
আর আমি শুনি—সময়ও কখনো কখনো হাঁটু গেড়ে বসে।
প্রতিটি বিচ্ছেদ আসলে একটি নতুন প্রার্থনা,
যা আমরা চুরি করে রাখি একে অপরের আঙুলের ছাপের ভেতর।
তোমার নরম নীরবতাই আমার শেষ সন্ধ্যার আকাশ,
যেখানে ডুবে থাকা রোদও জেগে ওঠে নতুন রঙে।
জীবন যদি রূপহীন কোনো আলো হয়,
তবে তার সবচেয়ে স্পষ্ট ছায়া তুমি।
