পর্ব - ১৬
অদিতি রক্তচোখের নদী পার হয়ে এখন অনেকটা নিস্তব্ধ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে।
তার হাতে ধরা সত্যের কণা, নীল আলোয় ধুকপুক করছে যেন জীবন্ত হৃদস্পন্দনের মতো।
সে মৃদু ফিসফিস করে বলল—
“অর্ণব, আমি তৃতীয় রহস্য পেয়েছি… এখন আর পেছনে ফেরার পথ নেই।”
কিন্তু বুকের ভেতর ভারী হয়ে আছে এক অদৃশ্য চাপ।
কারণ নদী তার কাছ থেকে এমন একটা স্বীকারোক্তি নিয়ে গেছে, যা সে কাউকে কোনোদিন বলতে চায়নি— অর্ণব ছাড়া বাঁচতে পারবে না।
সামনে হঠাৎ অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল।
একটা সিঁড়ি আকাশ ছুঁয়ে গেছে, কিন্তু তার প্রতিটি ধাপ হাওয়ায় ঝুলছে।
মাটির কোনো টান নেই, যেন বাতাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
পথিকের কণ্ঠ শোনা গেল চারদিক থেকে—
“এটাই অলীক সিঁড়ি। এখানে প্রতিটি ধাপে তোমার ভুলে যাওয়া স্মৃতি তোমাকে ডাকবে।
যদি ভয় পাও, ধাপ ভেঙে যাবে আর তুমি শূন্যতায় পড়ে যাবে।”
অদিতি সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়াল।
তার হাত কাঁপছে, কিন্তু চোখে একই দৃঢ়তা।
অদিতি সিঁড়িতে পা রাখতেই চারপাশে ভেসে উঠল শৈশবের দৃশ্য।
ছোট্ট অদিতি মাঠে দৌড়াচ্ছে, হাতে লাল ফড়িং ধরা।
কিন্তু সেই আনন্দময় মুহূর্ত হঠাৎ অন্ধকারে ঢাকা পড়ল।
সে শুনল, কেউ কণ্ঠস্বর তুলছে—
“অদিতি, তুমি তখনই প্রথম শিখেছিলে লুকোতে। কান্না চাপতে।
যখন তোমার প্রিয় খেলনা কেউ ভেঙে দিল, তুমি হেসেছিলে। অথচ ভেতরে কেঁদেছিলে।”
অদিতির বুক ফেটে গেল।
সে ঠোঁট কামড়ে বলল—
“হ্যাঁ, আমি তখন থেকেই শিখেছি… যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু অর্ণবের সামনে আমি কখনো লুকাতে চাইনি।”
সিঁড়ির ধাপ জ্বলে উঠল।
সে আরও ওপরে উঠতেই দেখা দিল আরেক স্মৃতি।
কলেজের দিন—
একজন ছেলেকে সে বন্ধুর মতো কাছে টেনেছিল, কিন্তু তার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
সেই ছেলেটির কণ্ঠ শোনা গেল—
“অদিতি, তুমি ভেবেছিলে অর্ণবই তোমার সবকিছু।
কিন্তু তুমি কি জানো, আমার ভাঙা হৃদয়ের দায়ও তোমার ওপর?”
অদিতির চোখ ভিজে গেল।
“হয়তো আমি কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আমি কাউকে প্রতারণা করিনি। আমি শুধু অর্ণবকেই সত্যি ভালোবেসেছি।”
ধাপ জ্বলে উঠল, অন্ধকার মুছে গেল।
ওদিকে অর্ণব শূন্যতার ভেতর হাঁটছে।
হঠাৎ তার চারপাশে অসংখ্য আয়না ভেসে উঠল, প্রতিটিতে তার নিজস্ব চেহারা।
কিন্তু একেকটা মুখ অন্যরকম—
একটা চেহারায় সে বুড়ো, একটায় শিশু, একটায় সম্পূর্ণ অচেনা।
অদৃশ্য কণ্ঠ বলল—
“অর্ণব, তুমি আসলে কে?
তুমি কি অদিতির স্বপ্ন, নাকি বাস্তবের মানুষ?
যদি সে ঘুমপুর ছেড়ে দেয়, তুমি কোথায় থাকবে?”
অর্ণবের কপাল ঘামতে লাগল।
সে হাত বাড়িয়ে আয়নায় স্পর্শ করল—
“আমি… আমি অদিতির সত্যি। আমি শুধু তার স্বপ্ন নই।”
আয়না ফেটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।
অদিতি এবার সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে উঠল।
সাথে সাথে তার সামনে ফুটে উঠল এক অন্ধকার ঘর।
সে নিজেকে দেখতে পেল—চোখে অশ্রু, হাতে ভাঙা চিঠি।
সেই চিঠি যা অর্ণবকে দেওয়ার সাহস সে কোনোদিন পায়নি।
চিঠিতে লেখা ছিল—
“অর্ণব, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।
কিন্তু যদি কখনো তুমি আমাকে ছেড়ে যাও, আমি সব শেষ করে ফেলব।”
অদিতির মুখ সাদা হয়ে গেল।
“না… আমি তো এই কথা ভুলে গিয়েছিলাম…”
পথিকের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“এটাই তোমার সবচেয়ে গভীর সত্য।
তুমি নিজেকে বলেছিলে শক্ত মেয়ে। অথচ তোমার ভেতরে মৃত্যুর ছায়া লুকিয়ে আছে।”
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
সে চোখ বুজে কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“হ্যাঁ… আমি দুর্বল। কিন্তু আমি লড়ব। যতক্ষণ অর্ণব বেঁচে আছে, আমি হার মানব না।”
ধাপটা আলোকিত হলো। সিঁড়ি আরও ওপরে নিয়ে গেল তাকে।
অলীক সিঁড়ির শেষে এক ঝলমলে আলো।
অদিতি সেখানে পৌঁছে দেখতে পেল—
একটি সোনালি পালক ভেসে আছে বাতাসে।
পথিক হঠাৎ তার পাশে দাঁড়াল।
তার চোখে এবার অদ্ভুত কোমলতা।
সে বলল—
“এটাই পঞ্চম রহস্য—স্মৃতির পালক।
তুমি চাইলে এর দ্বারা কারও ভোলা স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারবে… কিংবা চিরতরে মুছে দিতে পারবে।”
অদিতির হাত কেঁপে উঠল।
“অর্ণব… আমি ওর প্রতিটি স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চাই।”
পথিক তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল—
“সাবধান, অদিতি। সত্যিকারের ভালোবাসা স্মৃতি ধরে রাখে, আবার মুক্তও করে। তুমি কী করতে পারবে?”
অদিতির চোখ ভিজে উঠল।
সে পালক বুকে চেপে ধরল।
এবার তার যাত্রা আরও ভয়ানক রহস্যের দিকে—স্মৃতির পালক।
পর্ব - ১৭
অদিতি অলীক সিঁড়ির শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকল।
হাওয়া যেন থমকে গেছে, চুপচাপ।
তার লক্ষ্য ধরা পঞ্চম রহস্যে স্মৃতির পালক, নরম সোনালি আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে।
পথিক তার পাশে, চোখে অদ্ভুত রহস্যময় দমক।
—“এটাই পঞ্চম রহস্য, অদিতি—স্মৃতির পালক।
এখানে প্রতিটি স্মৃতি শুধুই নয়, বরং প্রতিটি আত্মার গল্পও বাঁধা।
তুমি চাইলে স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারবে, বা চিরতরে মুছে দিতে পারবে।”
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
—“আমি চাই অর্ণবের প্রতিটি হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে।
যেখানে সে ভুলে গেছে, আমি সেখানে যেতে চাই।”
পথিক মাথা নাড়ল।
—“সাবধান, অদিতি। প্রতিটি স্মৃতি নিজের ভেতরের সত্যও প্রকাশ করে।
যদি তুমি খুব গভীরে নামো, হয়তো নিজের কিছু অজানা সত্যও দেখতে হবে।”
অদিতি পালক বুকে চেপে ধরে জলে নেমে এলো।
হঠাৎ চারপাশে অসংখ্য আয়নার মতো ভাসতে থাকা বুদবুদ দেখা গেল।
প্রতিটি বুদবুদে ভেসে আছে স্মৃতি—কিছু আনন্দময়, কিছু কাঁদানো।
পালক হালকা ঝলসে উঠল।
একটি বুদবুদ ভেসে এলো তার সামনে—
অর্ণবের কলেজের দিন, সে প্রথমবার হাসল অদিতির দিকে।
অদিতি হেসে উঠল, চোখে আনন্দের জল।
কিন্তু পাশে আরেকটি বুদবুদ—
অর্ণব একা বসে, অদিতির অনুপস্থিতিতে কান্না করছে।
অদিতি হঠাৎ বুঝল—প্রতি আনন্দের পেছনে কোনো না কোনো কষ্ট লুকিয়ে আছে।
পালক হঠাৎ নীল থেকে সোনালি হয়ে গেল।
বুদবুদগুলো ভাঙতে লাগল, প্রতিটি স্মৃতির সঙ্গে অদিতি অনুভব করল যে, প্রতিটি স্মৃতির মধ্যে অন্য একজন আত্মার ছায়া বাঁধা।
একটি বুদবুদে দেখা গেল—এক বৃদ্ধার চোখ ভিজে আছে, সে নিজের ছেলেকে হারিয়েছে।
অদিতি হালকা ফিসফিস করল—
“এই স্মৃতিগুলোও কি সত্য?”
পথিকের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“স্মৃতি সবসময় সত্য নয়, কিন্তু প্রতিটি আত্মার গল্প এখানে বাঁধা। তুমি যে স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছ, তা শুধুই অর্ণবের নয়—অনেককে মুক্ত করবে।”
অদিতি এক বিশেষ বুদবুদ ধরল।
এটা অর্ণবের শিশুকাল—
সে ছোট্ট ছেলেটি হাতে খেলনা ধরে, কিন্তু পাশে কেউ নেই।
অদিতি দম বন্ধ করে তাকাল।
পালক হালকা ঝলসে উঠল, বুদবুদ খুলে গেল।
অদিতি অনুভব করল—এই ক্ষুদ্র স্মৃতির ভেতর দিয়ে অর্ণবের সমস্ত একাকিত্ব ভেসে আসে।
তার কণ্ঠে কেঁপে উঠল—
“অর্ণব… সব কিছু ফিরিয়ে আনছি।”
বুদবুদ ভেঙে যায়, আর অদিতি হাতের স্পর্শে নরম আলো ছড়ায়।
জলে ভেসে ওঠে অর্ণবের কণ্ঠের হালকা প্রতিধ্বনি—
“অদিতি… তুমি আসলে বুঝছ না, তুমি শুধু স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছ না, আমাকে আবার জীবন্ত করছ।”
কিন্তু তারপর হঠাৎ পালক অদ্ভুতভাবে দাপিয়ে উঠল।
নরম আলো কালো ছায়ায় মিশে গেল।
অদিতি দেখল—একটি বুদবুদ ভেঙে গেছে, যেখানে তার নিজের ভীতির স্মৃতি ধরা ছিল।
পালক কণ্ঠে ভেসে এলো—
“স্মৃতির পালক শুধুই অন্যকে ফেরাতে পারে না, অদিতি।
তোমার ভেতরের সত্য, যা তুমি সবসময় লুকিয়েছিলে, তা বেরিয়ে আসবে।”
অদিতি বুকের ভেতর কেঁপে উঠল।
সে চোখ বন্ধ করে বলল—
“আমি প্রস্তুত।
অর্ণবের জন্য আমার সব সত্যই দেখাব।”
পালক হঠাৎ নীল-সোনালি আলো ছড়াল চারপাশে।
অদিতি অনুভব করল—যে শক্তি আগে কেবল অর্ণবের কাছে সীমিত ছিল, এখন তার হাতেও এসেছে।
পথিক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল—
“তুমি পঞ্চম রহস্য অর্জন করেছ।
তোমার হৃদয়, তোমার ভালোবাসা, এবং তোমার নিজের সত্য—সব একত্র হয়ে এখন শক্তি তৈরি করছে।
পরবর্তী যাত্রা আরও কঠিন—ষষ্ঠ রহস্য, শূন্যবীণা।
যেখানে মৃতদের সুর শোনাবে, এবং অতীতের সব অশান্তি জেগে উঠবে।”
অদিতি হাত শক্ত করে পালক চেপে ধরল।
চোখে অদম্য আগুন, মুখে দৃঢ় শপথ—
“যতই ভয় হোক, যতই কষ্ট হোক, আমি থামব না। অর্ণবকে ফেরানো আমার একমাত্র লক্ষ্য।”
পর্ব - ১৮
অদিতি স্মৃতির পালক শক্ত করে চেপে ধরে, নীল-সোনালি আলো ছড়াচ্ছে চারপাশে।
পথিক তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল—
—“এবার তোমার পরীক্ষা ষষ্ঠ রহস্য—শূন্যবীণা।
যার সুর শুনতে পাবে কেবল মৃতরা। কিন্তু তুমি শুনবে। এবং সেই সুর তোমার ভেতরের সব অশান্তি, সব অজানা সত্য উন্মোচন করবে।”
অদিতি গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—“আমি প্রস্তুত।”
পথিক হঠাৎ অদ্ভুত কণ্ঠে ফিসফিস করল—
—“শুনে রাখো, অদিতি, শূন্যবীণার সুরকে তুমি বাঁচাতে পারবে, বা হারাতে পারবে। কিন্তু কোনো ভুল হলে, অতীত এবং ভবিষ্যৎ দুটোই তোমার জন্য অচল হয়ে যাবে।”
সামনের বাগানে একটি বিশাল শূন্যবীণা ভেসে উঠল।
যেমন আকাশে ঝুলছে, তার দড়ি অদৃশ্য।
যখন অদিতি তার কাছে এগোল, শূন্যবীণা হালকা কম্পিত হয়ে ওঠল।
একটি সূক্ষ্ম সুর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
সুরে নয়, বরং শব্দে—শূন্যতার ভয়।
অদিতি অনুভব করল—প্রতিটি নোট তার ভেতরের স্মৃতি নাড়িয়ে দিচ্ছে।
শৈশবের কষ্ট, হারানো বন্ধু, প্রথম প্রেমের ব্যথা—সব একে একে তার সামনে ভেসে উঠল।
পথিক কণ্ঠে বলল—
—“এখানে তুমি শুধুই মৃতদের কথা শুনবে না।
তোমার নিজের ভয় এবং অজানা সত্যও গান হয়ে উঠবে। তুমি কি ধৈর্য রাখতে পারবে?”
হঠাৎ বাতাসে ভেসে এলো এক কণ্ঠ।
—“অদিতি… তুমি আমাদের স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছ?”
অদিতি হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ল।
শূন্যবীণার প্রতিটি সুর যেন মৃতদের কণ্ঠে রূপান্তরিত হল।
সে শুনল—ছেলেটি যে একসময় তার স্কুলের বন্ধু ছিল, এখন অচেনা এক আত্মার ভেতর বেঁচে আছে।
প্রতিটি সুর যেন তাকে বলে দিচ্ছে—“তুমি ভুলে গিয়েছিলে, কিন্তু আমরা এখনও এখানে।”
অদিতি চোখ ভিজে গেল।
—“আমি ভুলতে চাই না। আমি সব স্মৃতি ফিরিয়ে আনব।”
শূন্যবীণা হালকা কম্পিত হয়ে, নীল-সোনালি আলো ছড়াল।
শূন্যবীণা আরও জোরে সুর তুলল।
অদিতি হঠাৎ নিজের ভেতরের সব অজানা ভয় দেখল—
সেই রাত যখন প্রথমবার অর্ণবের জন্য কান্না করেছিল।
সেই সময় যখন নিজেকে শক্ত মেয়ে ভেবে দম্ভ করেছিল, অথচ ভেতরে ভয় আর একাকিত্ব ছিল।
যে চিঠি সে কখনও পাঠায়নি, তার ভেতরের লুকানো কথা।
অদিতি বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, কিন্তু চোখে দৃঢ়তা আরও বেড়ে গেল।
—“সব স্বীকার করছি। সব সত্যকে আমার কাছে আনছি।
অর্ণবের জন্য, আমি কোনো কিছু লুকাব না।”
শূন্যবীণার সুর হঠাৎ শান্ত হলো।
একটি নীল আলো তাকে ঢেকে দিল, যেন সব অতীত ও মৃতদের কণ্ঠ মিলিয়ে তাকে নতুন শক্তি দিচ্ছে।
পথিক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল—
—“অদিতি, তুমি ষষ্ঠ রহস্য পেরেছ।
এবার তুমি শুধু অর্ণবকে খুঁজছ না, বরং নিজের সমস্ত সত্যও খুঁজেছ।
তৃতীয় চোখ খোলা হয়েছে। কিন্তু মনে রেখো—সপ্তম রহস্য, অদৃশ্য শিলা, তোমার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে।
যেখানে নদীর বাঁধন, সমস্ত অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মিলিত হবে।”
অদিতি হাত শক্ত করে পালক ও শূন্যবীণা ধরে বলল—
—“আমি থামব না। যতই রহস্য হোক, যতই পরীক্ষা হোক, আমি অর্ণবকে ফিরিয়ে আনব।”
আকাশে হালকা ঝলক—নিশ্চিত ইঙ্গিত যে, শেষ রহস্যের পথে পথ খোলা হয়েছে।
পর্ব - ১৯
অদিতি এখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে।
নদী থেমে গেছে, পানি স্থির, কিন্তু তার ভেতর লুকানো শক্তি যেন অদৃশ্য শিলা ধরে রাখছে।
শিলা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু নদী নিজেই জানাচ্ছে তার উপস্থিতি—প্রতিটি ঢেউয়ে, প্রতিটি বাতাসের স্রোতে।
পথিক ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বলল—
—“এটাই সপ্তম রহস্য।
যেখানে শিলা আছে, সেখানেই নদীর বাঁধন, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মিলিত হবে।
সত্য প্রকাশ পাবে, অদিতি। তুমি কি প্রস্তুত?”
অদিতি চোখ মেলে নদীর দিকে তাকাল।
—“আমি প্রস্তুত। সব সত্য জানার জন্য, আমি ধৈর্য রাখব।”
নদী হঠাৎ গর্জে উঠল।
এক অদৃশ্য শক্তি তার হাতের স্বপ্নফুল, নীল আলো এবং শূন্যবীণা টানতে লাগল।
পালক হালকা ঝলসে উঠল।
শিলা তখনই অদিতিকে পরীক্ষা শুরু করল—
প্রথমে দেখা গেল তার অতীতের সমস্ত ভুল।
সে দেখল—শৈশবের সময় নিজের ভয় লুকিয়েছিল, কলেজে বন্ধুদের কষ্ট দিয়েছিল, অর্ণবের কাছে কিছু কথা লুকিয়েছিল।
পথিক কণ্ঠে ফিসফিস করল—
—“এখানে কোনো মিথ্যা লুকানো যাবে না।
শিলা সবকিছু দেখবে, প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি অনুভূতি। তুমি কি সাহসী?”
অদিতি বুকের ভেতর কাঁপছে অনুভব করল।
—“আমি আর ভয় পাই না। সব সত্য সামনে আনব।”
হঠাৎ নদীর পানি উত্তাল হয়ে উঠল।
প্রতিটি ঢেউ ভেসে আনে মৃতদের কণ্ঠ, হারানো স্মৃতি, অর্ণবের হাসি এবং কান্না।
শিলা অদৃশ্যভাবে নদীর মধ্য দিয়ে অদিতির সামনে ধীরে ধীরে স্থির হলো।
পালক নীল আলো ছড়াল চারদিকে।
অদিতি বুঝল—শিলা শুধুই পরীক্ষা করছে না, এটি নদীর বাঁধন, যেখানে সব সত্য মিলিত হবে।
সে জলে পা রাখল।
প্রতিটি স্পর্শে, প্রতিটি ঢেউয়ে সে অনুভব করল—অর্ণবের সমস্ত স্মৃতি ও ভালোবাসা তাকে ফিরে আসছে।
ওদিকে আয়নার জগতে অর্ণবও নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে।
সে নিজেকে দেখে—শূন্যতা, হারানো সময়, এবং অদিতির লড়াই।
এক অদৃশ্য কণ্ঠ বলল—
—“অর্ণব, যদি তুমি সত্যিই তাকে হারাতে চাও না, তোমার নিজের ভেতরের সব ভয় ও সন্দেহ দূর করতে হবে।”
অর্ণব হাত বাড়িয়ে আয়নায় স্পর্শ করল।
—“আমি চাই অদিতি ফিরে আসুক।
আমি তার জন্য সব হারাতে প্রস্তুত।”
আয়না ধীরে ধীরে আলো ছড়াতে শুরু করল।
অদিতি নদীর মাঝ বরাবর পৌঁছালো।
শিলা হঠাৎ স্থির হয়ে নদীর সমস্ত শক্তি তার হাতে নিয়ে এল।
পালক, শূন্যবীণা, স্বপ্নফুল— সমস্ত একত্র হয়ে একটি জ্যোতির্ময় আলো তৈরি করল।
নদীর ঢেউয়ে অর্ণবের চেহারা ভেসে উঠল।
অদিতি কাঁপতে কাঁপতে বলল—
—“অর্ণব, তুমি ফিরেছো। সব সত্য, সব স্মৃতি—সব আমি তোমার জন্য রেখেছি।”
আকাশে ঝলক, নদী শান্ত, শিলা অদৃশ্য।
পথিক ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল, রেখে গেল শুধু মৃদু কণ্ঠ—
—“সত্যিকারের ভালোবাসা সব বাধা পার করতে পারে।”
অদিতি অর্ণবের দিকে এগিয়ে গেল।
তাদের চোখে মিলল সেই অদম্য ভালোবাসা, যা সপ্ত রহস্যের প্রতিটি পরীক্ষায় তৈরি হয়েছে।
অন্তিম পর্ব
অদিতি ও অর্ণব নদীর তীরে দাঁড়িয়ে।
শিশির ভেজা বাতাসে নরম আলো ঝলমল করছে।
সপ্তম রহস্য, অদৃশ্য শিলা, এখন অদৃশ্য, কিন্তু তার শক্তি পুরো শহরের ঘুমপুরে ছড়িয়ে পড়েছে।
অদিতি হাত ছুঁয়ে বলল—
—“অর্ণব, আমরা সব পার করেছি। সাতটি রহস্য, সাতটি পরীক্ষা, আর শেষ—আমাদের ভালোবাসা।”
অর্ণব এক গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—“হ্যাঁ, অদিতি। তোমার সাহস আর সত্যিকারের ভালোবাসাই আমাকে ফেরত এনেছে।
আমাদের মধ্যে আর কোনো বিভাজন নেই।”
নদী শান্ত, বাতাস মৃদু, কিন্তু চারপাশে এমন শক্তি—যা আগে কখনও তারা অনুভব করেনি।
হঠাৎ আকাশে হালকা ঝলক।
পথিকের কণ্ঠ ভেসে এলো—
—“অদিতি, অর্ণব, তোমাদের যাত্রা শেষ হলো না।
তোমরা সত্যিকারের সাক্ষাৎ করেছো, কিন্তু ঘুমপুরের শক্তি এখনও একটি পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে।
যে হৃদয় সব সত্য স্বীকার করে, সে সব রহস্যের অধিকারী।”
অদিতি নরমভাবে বলল—
—“আমরা প্রস্তুত।”
পথিক হেসে অদৃশ্য হয়ে গেল, রেখে গেল শুধু হালকা ঝলক।
নদীর জলে হঠাৎ সব আলো একত্র হয়ে শহরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি আয়নায় ছড়িয়ে পড়ল।
ঘুমপুরের মানুষ অচেতন অবস্থায় ঘুম থেকে জেগে উঠল, কিন্তু তাদের চোখে এক অদ্ভুত শান্তি।
প্রতিটি মানুষ যেন নিজের সত্যের মুখোমুখি হয়েছে, এবং হৃদয়ে মিলনের শক্তি অনুভব করছে।
অদিতি অর্ণবকে চুম্বন করল।
—“আমরা শুধু একে অপরকে ফিরে পাইনি, আমরা ঘুমপুরকেও ফিরিয়ে এনেছি।”
অর্ণব চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—“এটাই সত্যিকারের ভালোবাসা, অদিতি। যা সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে, সমস্ত সত্য উন্মোচিত করে।”
রাত গভীর, কিন্তু এখন এক অদ্ভুত শান্তি ঘুমপুরে।
নদীর ঢেউয়ে হালকা ঝলক, বাতাসে নরম সুর।
অদিতি আর অর্ণব একে অপরের হাত ধরে হাঁটছে।
পাশে নেই ভয়, নেই বিভাজন, শুধু আছে এক অনন্ত মিলন।
পথিকের কণ্ঠ ভেসে এলো শেষবার—
—“সত্যিকারের ভালোবাসা, সাহস এবং ধৈর্য যিনি রাখেন, তার জন্য ঘুমপুর সব রহস্য উন্মোচিত।
অদিতি, অর্ণব, তোমরা সেই যোদ্ধা।”
অদিতি হাসল, চোখে আনন্দের জল।
—“আমরা সব পার করেছি। আর কোনো রহস্য নেই।”
অর্ণবও হেসে বলল—
—“তবে ঘুমপুর আমাদের গল্প মনে রাখবে। আমাদের ভালোবাসা চিরকাল বাঁচবে।”
নদী হালকা স্রোতে শান্ত, চাঁদ ওঠে আকাশে।
শহর ঘুমপুরে আলো ঝলকানো, আর অদিতি ও অর্ণব একে অপরের হাত ধরে ধীরে ধীরে অদৃশ্য অন্ধকারের মাঝে মিলিয়ে গেল।
অদিতি অলীক সিঁড়ির শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকল।
হাওয়া যেন থমকে গেছে, চুপচাপ।
তার লক্ষ্য ধরা পঞ্চম রহস্যে স্মৃতির পালক, নরম সোনালি আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে।
পথিক তার পাশে, চোখে অদ্ভুত রহস্যময় দমক।
—“এটাই পঞ্চম রহস্য, অদিতি—স্মৃতির পালক।
এখানে প্রতিটি স্মৃতি শুধুই নয়, বরং প্রতিটি আত্মার গল্পও বাঁধা।
তুমি চাইলে স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারবে, বা চিরতরে মুছে দিতে পারবে।”
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
—“আমি চাই অর্ণবের প্রতিটি হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে।
যেখানে সে ভুলে গেছে, আমি সেখানে যেতে চাই।”
পথিক মাথা নাড়ল।
—“সাবধান, অদিতি। প্রতিটি স্মৃতি নিজের ভেতরের সত্যও প্রকাশ করে।
যদি তুমি খুব গভীরে নামো, হয়তো নিজের কিছু অজানা সত্যও দেখতে হবে।”
অদিতি পালক বুকে চেপে ধরে জলে নেমে এলো।
হঠাৎ চারপাশে অসংখ্য আয়নার মতো ভাসতে থাকা বুদবুদ দেখা গেল।
প্রতিটি বুদবুদে ভেসে আছে স্মৃতি—কিছু আনন্দময়, কিছু কাঁদানো।
পালক হালকা ঝলসে উঠল।
একটি বুদবুদ ভেসে এলো তার সামনে—
অর্ণবের কলেজের দিন, সে প্রথমবার হাসল অদিতির দিকে।
অদিতি হেসে উঠল, চোখে আনন্দের জল।
কিন্তু পাশে আরেকটি বুদবুদ—
অর্ণব একা বসে, অদিতির অনুপস্থিতিতে কান্না করছে।
অদিতি হঠাৎ বুঝল—প্রতি আনন্দের পেছনে কোনো না কোনো কষ্ট লুকিয়ে আছে।
পালক হঠাৎ নীল থেকে সোনালি হয়ে গেল।
বুদবুদগুলো ভাঙতে লাগল, প্রতিটি স্মৃতির সঙ্গে অদিতি অনুভব করল যে, প্রতিটি স্মৃতির মধ্যে অন্য একজন আত্মার ছায়া বাঁধা।
একটি বুদবুদে দেখা গেল—এক বৃদ্ধার চোখ ভিজে আছে, সে নিজের ছেলেকে হারিয়েছে।
অদিতি হালকা ফিসফিস করল—
“এই স্মৃতিগুলোও কি সত্য?”
পথিকের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“স্মৃতি সবসময় সত্য নয়, কিন্তু প্রতিটি আত্মার গল্প এখানে বাঁধা। তুমি যে স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছ, তা শুধুই অর্ণবের নয়—অনেককে মুক্ত করবে।”
অদিতি এক বিশেষ বুদবুদ ধরল।
এটা অর্ণবের শিশুকাল—
সে ছোট্ট ছেলেটি হাতে খেলনা ধরে, কিন্তু পাশে কেউ নেই।
অদিতি দম বন্ধ করে তাকাল।
পালক হালকা ঝলসে উঠল, বুদবুদ খুলে গেল।
অদিতি অনুভব করল—এই ক্ষুদ্র স্মৃতির ভেতর দিয়ে অর্ণবের সমস্ত একাকিত্ব ভেসে আসে।
তার কণ্ঠে কেঁপে উঠল—
“অর্ণব… সব কিছু ফিরিয়ে আনছি।”
বুদবুদ ভেঙে যায়, আর অদিতি হাতের স্পর্শে নরম আলো ছড়ায়।
জলে ভেসে ওঠে অর্ণবের কণ্ঠের হালকা প্রতিধ্বনি—
“অদিতি… তুমি আসলে বুঝছ না, তুমি শুধু স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছ না, আমাকে আবার জীবন্ত করছ।”
কিন্তু তারপর হঠাৎ পালক অদ্ভুতভাবে দাপিয়ে উঠল।
নরম আলো কালো ছায়ায় মিশে গেল।
অদিতি দেখল—একটি বুদবুদ ভেঙে গেছে, যেখানে তার নিজের ভীতির স্মৃতি ধরা ছিল।
পালক কণ্ঠে ভেসে এলো—
“স্মৃতির পালক শুধুই অন্যকে ফেরাতে পারে না, অদিতি।
তোমার ভেতরের সত্য, যা তুমি সবসময় লুকিয়েছিলে, তা বেরিয়ে আসবে।”
অদিতি বুকের ভেতর কেঁপে উঠল।
সে চোখ বন্ধ করে বলল—
“আমি প্রস্তুত।
অর্ণবের জন্য আমার সব সত্যই দেখাব।”
পালক হঠাৎ নীল-সোনালি আলো ছড়াল চারপাশে।
অদিতি অনুভব করল—যে শক্তি আগে কেবল অর্ণবের কাছে সীমিত ছিল, এখন তার হাতেও এসেছে।
পথিক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল—
“তুমি পঞ্চম রহস্য অর্জন করেছ।
তোমার হৃদয়, তোমার ভালোবাসা, এবং তোমার নিজের সত্য—সব একত্র হয়ে এখন শক্তি তৈরি করছে।
পরবর্তী যাত্রা আরও কঠিন—ষষ্ঠ রহস্য, শূন্যবীণা।
যেখানে মৃতদের সুর শোনাবে, এবং অতীতের সব অশান্তি জেগে উঠবে।”
অদিতি হাত শক্ত করে পালক চেপে ধরল।
চোখে অদম্য আগুন, মুখে দৃঢ় শপথ—
“যতই ভয় হোক, যতই কষ্ট হোক, আমি থামব না। অর্ণবকে ফেরানো আমার একমাত্র লক্ষ্য।”
পর্ব - ১৮
অদিতি স্মৃতির পালক শক্ত করে চেপে ধরে, নীল-সোনালি আলো ছড়াচ্ছে চারপাশে।
পথিক তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল—
—“এবার তোমার পরীক্ষা ষষ্ঠ রহস্য—শূন্যবীণা।
যার সুর শুনতে পাবে কেবল মৃতরা। কিন্তু তুমি শুনবে। এবং সেই সুর তোমার ভেতরের সব অশান্তি, সব অজানা সত্য উন্মোচন করবে।”
অদিতি গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—“আমি প্রস্তুত।”
পথিক হঠাৎ অদ্ভুত কণ্ঠে ফিসফিস করল—
—“শুনে রাখো, অদিতি, শূন্যবীণার সুরকে তুমি বাঁচাতে পারবে, বা হারাতে পারবে। কিন্তু কোনো ভুল হলে, অতীত এবং ভবিষ্যৎ দুটোই তোমার জন্য অচল হয়ে যাবে।”
সামনের বাগানে একটি বিশাল শূন্যবীণা ভেসে উঠল।
যেমন আকাশে ঝুলছে, তার দড়ি অদৃশ্য।
যখন অদিতি তার কাছে এগোল, শূন্যবীণা হালকা কম্পিত হয়ে ওঠল।
একটি সূক্ষ্ম সুর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
সুরে নয়, বরং শব্দে—শূন্যতার ভয়।
অদিতি অনুভব করল—প্রতিটি নোট তার ভেতরের স্মৃতি নাড়িয়ে দিচ্ছে।
শৈশবের কষ্ট, হারানো বন্ধু, প্রথম প্রেমের ব্যথা—সব একে একে তার সামনে ভেসে উঠল।
পথিক কণ্ঠে বলল—
—“এখানে তুমি শুধুই মৃতদের কথা শুনবে না।
তোমার নিজের ভয় এবং অজানা সত্যও গান হয়ে উঠবে। তুমি কি ধৈর্য রাখতে পারবে?”
হঠাৎ বাতাসে ভেসে এলো এক কণ্ঠ।
—“অদিতি… তুমি আমাদের স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছ?”
অদিতি হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ল।
শূন্যবীণার প্রতিটি সুর যেন মৃতদের কণ্ঠে রূপান্তরিত হল।
সে শুনল—ছেলেটি যে একসময় তার স্কুলের বন্ধু ছিল, এখন অচেনা এক আত্মার ভেতর বেঁচে আছে।
প্রতিটি সুর যেন তাকে বলে দিচ্ছে—“তুমি ভুলে গিয়েছিলে, কিন্তু আমরা এখনও এখানে।”
অদিতি চোখ ভিজে গেল।
—“আমি ভুলতে চাই না। আমি সব স্মৃতি ফিরিয়ে আনব।”
শূন্যবীণা হালকা কম্পিত হয়ে, নীল-সোনালি আলো ছড়াল।
শূন্যবীণা আরও জোরে সুর তুলল।
অদিতি হঠাৎ নিজের ভেতরের সব অজানা ভয় দেখল—
সেই রাত যখন প্রথমবার অর্ণবের জন্য কান্না করেছিল।
সেই সময় যখন নিজেকে শক্ত মেয়ে ভেবে দম্ভ করেছিল, অথচ ভেতরে ভয় আর একাকিত্ব ছিল।
যে চিঠি সে কখনও পাঠায়নি, তার ভেতরের লুকানো কথা।
অদিতি বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, কিন্তু চোখে দৃঢ়তা আরও বেড়ে গেল।
—“সব স্বীকার করছি। সব সত্যকে আমার কাছে আনছি।
অর্ণবের জন্য, আমি কোনো কিছু লুকাব না।”
শূন্যবীণার সুর হঠাৎ শান্ত হলো।
একটি নীল আলো তাকে ঢেকে দিল, যেন সব অতীত ও মৃতদের কণ্ঠ মিলিয়ে তাকে নতুন শক্তি দিচ্ছে।
পথিক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল—
—“অদিতি, তুমি ষষ্ঠ রহস্য পেরেছ।
এবার তুমি শুধু অর্ণবকে খুঁজছ না, বরং নিজের সমস্ত সত্যও খুঁজেছ।
তৃতীয় চোখ খোলা হয়েছে। কিন্তু মনে রেখো—সপ্তম রহস্য, অদৃশ্য শিলা, তোমার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে।
যেখানে নদীর বাঁধন, সমস্ত অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মিলিত হবে।”
অদিতি হাত শক্ত করে পালক ও শূন্যবীণা ধরে বলল—
—“আমি থামব না। যতই রহস্য হোক, যতই পরীক্ষা হোক, আমি অর্ণবকে ফিরিয়ে আনব।”
আকাশে হালকা ঝলক—নিশ্চিত ইঙ্গিত যে, শেষ রহস্যের পথে পথ খোলা হয়েছে।
পর্ব - ১৯
অদিতি এখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে।
নদী থেমে গেছে, পানি স্থির, কিন্তু তার ভেতর লুকানো শক্তি যেন অদৃশ্য শিলা ধরে রাখছে।
শিলা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু নদী নিজেই জানাচ্ছে তার উপস্থিতি—প্রতিটি ঢেউয়ে, প্রতিটি বাতাসের স্রোতে।
পথিক ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বলল—
—“এটাই সপ্তম রহস্য।
যেখানে শিলা আছে, সেখানেই নদীর বাঁধন, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মিলিত হবে।
সত্য প্রকাশ পাবে, অদিতি। তুমি কি প্রস্তুত?”
অদিতি চোখ মেলে নদীর দিকে তাকাল।
—“আমি প্রস্তুত। সব সত্য জানার জন্য, আমি ধৈর্য রাখব।”
নদী হঠাৎ গর্জে উঠল।
এক অদৃশ্য শক্তি তার হাতের স্বপ্নফুল, নীল আলো এবং শূন্যবীণা টানতে লাগল।
পালক হালকা ঝলসে উঠল।
শিলা তখনই অদিতিকে পরীক্ষা শুরু করল—
প্রথমে দেখা গেল তার অতীতের সমস্ত ভুল।
সে দেখল—শৈশবের সময় নিজের ভয় লুকিয়েছিল, কলেজে বন্ধুদের কষ্ট দিয়েছিল, অর্ণবের কাছে কিছু কথা লুকিয়েছিল।
পথিক কণ্ঠে ফিসফিস করল—
—“এখানে কোনো মিথ্যা লুকানো যাবে না।
শিলা সবকিছু দেখবে, প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি অনুভূতি। তুমি কি সাহসী?”
অদিতি বুকের ভেতর কাঁপছে অনুভব করল।
—“আমি আর ভয় পাই না। সব সত্য সামনে আনব।”
হঠাৎ নদীর পানি উত্তাল হয়ে উঠল।
প্রতিটি ঢেউ ভেসে আনে মৃতদের কণ্ঠ, হারানো স্মৃতি, অর্ণবের হাসি এবং কান্না।
শিলা অদৃশ্যভাবে নদীর মধ্য দিয়ে অদিতির সামনে ধীরে ধীরে স্থির হলো।
পালক নীল আলো ছড়াল চারদিকে।
অদিতি বুঝল—শিলা শুধুই পরীক্ষা করছে না, এটি নদীর বাঁধন, যেখানে সব সত্য মিলিত হবে।
সে জলে পা রাখল।
প্রতিটি স্পর্শে, প্রতিটি ঢেউয়ে সে অনুভব করল—অর্ণবের সমস্ত স্মৃতি ও ভালোবাসা তাকে ফিরে আসছে।
ওদিকে আয়নার জগতে অর্ণবও নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে।
সে নিজেকে দেখে—শূন্যতা, হারানো সময়, এবং অদিতির লড়াই।
এক অদৃশ্য কণ্ঠ বলল—
—“অর্ণব, যদি তুমি সত্যিই তাকে হারাতে চাও না, তোমার নিজের ভেতরের সব ভয় ও সন্দেহ দূর করতে হবে।”
অর্ণব হাত বাড়িয়ে আয়নায় স্পর্শ করল।
—“আমি চাই অদিতি ফিরে আসুক।
আমি তার জন্য সব হারাতে প্রস্তুত।”
আয়না ধীরে ধীরে আলো ছড়াতে শুরু করল।
অদিতি নদীর মাঝ বরাবর পৌঁছালো।
শিলা হঠাৎ স্থির হয়ে নদীর সমস্ত শক্তি তার হাতে নিয়ে এল।
পালক, শূন্যবীণা, স্বপ্নফুল— সমস্ত একত্র হয়ে একটি জ্যোতির্ময় আলো তৈরি করল।
নদীর ঢেউয়ে অর্ণবের চেহারা ভেসে উঠল।
অদিতি কাঁপতে কাঁপতে বলল—
—“অর্ণব, তুমি ফিরেছো। সব সত্য, সব স্মৃতি—সব আমি তোমার জন্য রেখেছি।”
আকাশে ঝলক, নদী শান্ত, শিলা অদৃশ্য।
পথিক ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল, রেখে গেল শুধু মৃদু কণ্ঠ—
—“সত্যিকারের ভালোবাসা সব বাধা পার করতে পারে।”
অদিতি অর্ণবের দিকে এগিয়ে গেল।
তাদের চোখে মিলল সেই অদম্য ভালোবাসা, যা সপ্ত রহস্যের প্রতিটি পরীক্ষায় তৈরি হয়েছে।
অন্তিম পর্ব
অদিতি ও অর্ণব নদীর তীরে দাঁড়িয়ে।
শিশির ভেজা বাতাসে নরম আলো ঝলমল করছে।
সপ্তম রহস্য, অদৃশ্য শিলা, এখন অদৃশ্য, কিন্তু তার শক্তি পুরো শহরের ঘুমপুরে ছড়িয়ে পড়েছে।
অদিতি হাত ছুঁয়ে বলল—
—“অর্ণব, আমরা সব পার করেছি। সাতটি রহস্য, সাতটি পরীক্ষা, আর শেষ—আমাদের ভালোবাসা।”
অর্ণব এক গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—“হ্যাঁ, অদিতি। তোমার সাহস আর সত্যিকারের ভালোবাসাই আমাকে ফেরত এনেছে।
আমাদের মধ্যে আর কোনো বিভাজন নেই।”
নদী শান্ত, বাতাস মৃদু, কিন্তু চারপাশে এমন শক্তি—যা আগে কখনও তারা অনুভব করেনি।
হঠাৎ আকাশে হালকা ঝলক।
পথিকের কণ্ঠ ভেসে এলো—
—“অদিতি, অর্ণব, তোমাদের যাত্রা শেষ হলো না।
তোমরা সত্যিকারের সাক্ষাৎ করেছো, কিন্তু ঘুমপুরের শক্তি এখনও একটি পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে।
যে হৃদয় সব সত্য স্বীকার করে, সে সব রহস্যের অধিকারী।”
অদিতি নরমভাবে বলল—
—“আমরা প্রস্তুত।”
পথিক হেসে অদৃশ্য হয়ে গেল, রেখে গেল শুধু হালকা ঝলক।
নদীর জলে হঠাৎ সব আলো একত্র হয়ে শহরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি আয়নায় ছড়িয়ে পড়ল।
ঘুমপুরের মানুষ অচেতন অবস্থায় ঘুম থেকে জেগে উঠল, কিন্তু তাদের চোখে এক অদ্ভুত শান্তি।
প্রতিটি মানুষ যেন নিজের সত্যের মুখোমুখি হয়েছে, এবং হৃদয়ে মিলনের শক্তি অনুভব করছে।
অদিতি অর্ণবকে চুম্বন করল।
—“আমরা শুধু একে অপরকে ফিরে পাইনি, আমরা ঘুমপুরকেও ফিরিয়ে এনেছি।”
অর্ণব চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—“এটাই সত্যিকারের ভালোবাসা, অদিতি। যা সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে, সমস্ত সত্য উন্মোচিত করে।”
রাত গভীর, কিন্তু এখন এক অদ্ভুত শান্তি ঘুমপুরে।
নদীর ঢেউয়ে হালকা ঝলক, বাতাসে নরম সুর।
অদিতি আর অর্ণব একে অপরের হাত ধরে হাঁটছে।
পাশে নেই ভয়, নেই বিভাজন, শুধু আছে এক অনন্ত মিলন।
পথিকের কণ্ঠ ভেসে এলো শেষবার—
—“সত্যিকারের ভালোবাসা, সাহস এবং ধৈর্য যিনি রাখেন, তার জন্য ঘুমপুর সব রহস্য উন্মোচিত।
অদিতি, অর্ণব, তোমরা সেই যোদ্ধা।”
অদিতি হাসল, চোখে আনন্দের জল।
—“আমরা সব পার করেছি। আর কোনো রহস্য নেই।”
অর্ণবও হেসে বলল—
—“তবে ঘুমপুর আমাদের গল্প মনে রাখবে। আমাদের ভালোবাসা চিরকাল বাঁচবে।”
নদী হালকা স্রোতে শান্ত, চাঁদ ওঠে আকাশে।
শহর ঘুমপুরে আলো ঝলকানো, আর অদিতি ও অর্ণব একে অপরের হাত ধরে ধীরে ধীরে অদৃশ্য অন্ধকারের মাঝে মিলিয়ে গেল।
<<•>>•••••• সমাপ্ত •••••••<<•>>
