পর্ব -১৩
অদিতি রাতভর হাঁটছিল নদীর ধার ধরে। আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে—অমাবস্যা। পথিকের কথাটা তার কানে বাজছিল,
“অমাবস্যার ঘণ্টা—যার ডাক শুনলে সময় থেমে যায়।”
নদীর ঘাট ছেড়ে সে পা বাড়াল জঙ্গলের দিকে। প্রতিটি পদক্ষেপে বাতাস ভারি হয়ে উঠছিল, গাছের ডালপালা যেন ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছিল। হঠাৎ চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
তখনই প্রথম শুনল—মৃদু ধাতব সুর, দূর থেকে ভেসে আসছে। ঘণ্টার শব্দ।
অদিতির বুক ধড়ফড় করে উঠল।
—“এটাই… অমাবস্যার ঘণ্টা।”
অদিতি যত এগোতে লাগল, তার চারপাশে অদ্ভুত পরিবর্তন হতে শুরু করল। পায়ের নিচে শুকনো পাতা পড়ে আছে, কিন্তু হাওয়ায় তার শব্দ নেই। গাছের ডাল হেলে যাচ্ছে, অথচ ঝিরঝির বাতাস নেই। নদীর ঢেউ থেমে গেছে মাঝপথে, যেন কারও হাতে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হঠাৎ অদিতি নিজের হাত বাড়িয়ে দেখল—তার আঙুলের নড়াচড়াও ধীর হয়ে গেছে। সময় থেমে গেছে। কেবল ঘণ্টার শব্দটা বাজছে অন্ধকারে।
সে বুঝল, এটাই সময়ের ফাঁদ। যদি সে নিয়ন্ত্রণ হারায়, তাহলে চিরকালের জন্য এই থেমে যাওয়া সময়ে আটকে যাবে।
ওদিকে, অর্ণব আয়নার জগতে তৃতীয় পরীক্ষার পর একটি নতুন দৃশ্য দেখতে পেল। এবার সে নিজের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে মুখোমুখি। প্রতিচ্ছবি ঠান্ডা স্বরে বলল,
—“তুমি অদিতিকে বিশ্বাস করছ। কিন্তু ভেবেছো কখনও, সে যদি তোমাকে ফিরিয়ে আনার বদলে এখানে আটকে রাখে?”
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল।
—“না! অদিতি কখনও এমন করবে না।”
প্রতিচ্ছবি হেসে উঠল।
—“বিশ্বাস—এটাই তোমার শক্তি, আবার দুর্বলতাও। মনে রেখো, যদি ভুল করো, ঘুমপুর তোমাকে গ্রাস করবে।”
আয়নাটা ফেটে গেল। এবার আয়নার ভেতর থেকে শুধু একটা আলোর রেখা ভেসে এলো, আকার নিল এক ঘণ্টার।
অর্ণব মনে মনে ধীরস্বরে বলল,
—“অদিতি… তুমি কি ওই ঘণ্টার কাছেই আছো?”
অদিতি অবশেষে এক প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে পৌঁছল। ভেতরে কালো পাথরের স্তম্ভে ঝুলছে একটি বিশাল ঘণ্টা। তার রূপালি ধাতু অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছে।
কিন্তু ঘণ্টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সত্তা—দীর্ঘদেহী, মাথায় ছায়ার মুকুট, চোখে জ্বলন্ত শূন্যতা। তার গলায় ভারী আওয়াজে বেরিয়ে এলো,
—“কে সময়কে ভাঙতে এসেছে? যে ঘণ্টা বাজাবে, সে নিজের জীবন ছিন্ন করবে। তুমি কি প্রস্তুত, অদিতি?”
অদিতি বুক সোজা করে দাঁড়াল।
—“হ্যাঁ। অর্ণবকে ফিরিয়ে আনতে আমি প্রস্তুত।”
ঠিক তখনই ছায়ার পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল। পথিক আবার ফিরে এসেছে।
সে হেসে বলল,
—“মনে রেখো, অদিতি, এই ঘণ্টা বাজানো মানে নিজের সময়কে পোড়ানো। কিন্তু যদি তুমি সফল হও, অর্ণবের কাছে এক ধাপ এগিয়ে যাবে।”
অদিতি ঘণ্টার দিকে তাকাল। তার হাতে স্বপ্নফুল এখনও জ্বলজ্বল করছে।
তার ঠোঁটে কেবল একটাই শব্দ—
—“অর্ণব…”
তারপর সে ঘণ্টার দড়িতে হাত বাড়াল।
(চলবে…)
