পর্ব -১২
অদিতি স্বপ্নফুল বুকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। জঙ্গলের নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভেঙে দিল সেই অচেনা মানুষের কণ্ঠ।
তার লম্বা কালো চাদর হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে আছে, চোখে গভীর অন্ধকার। যেন তার ভেতর পুরো বন ডুবে আছে।
সে মৃদু হাসল।
“তুমি সাহসী মেয়ে। খুব কম মানুষই অশ্রুকূপের সামনে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু তোমার হাতে যখন স্বপ্নফুল, তখন বুঝি তোমার ভালোবাসা সত্য।”
অদিতি সাবধানে প্রশ্ন করল—
“আপনি কে? রক্ষক নাকি শত্রু?”
লোকটা হেসে উঠল—
“আমি পথিক। সপ্ত রহস্যের প্রতিটি পথ আমি চিনি। আমি চাইলে তোমাকে সাহায্য করব, আবার চাইলে ধ্বংসও করতে পারি। আমার নিয়ম নেই।”
অদিতি দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“আমি অর্ণবকে ফেরাতে চাই। এজন্য সব ঝুঁকি নিতে রাজি।”
পথিক এক মুহূর্ত চুপ করে তাকে দেখল। তারপর বলল—
“তুমি যদি সত্যিই সব ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হও, তবে প্রতিটি রহস্য পাওয়ার পর আমাকে দেখাতে হবে। আমি যাচাই করব তুমি তার যোগ্য কিনা। নইলে তোমার সংগ্রাম বৃথা।”
অদিতি দ্বিধা করল, কিন্তু জানত অন্য কোনো পথ নেই।
“ঠিক আছে। আমি স্বপ্নফুল তোমাকে দেখাবো। কিন্তু প্রতারণা করলে আমি থেমে যাব না।”
পথিকের চোখে অদ্ভুত ঝিলিক ফুটল।
“তুমি আমাকে প্রতারণা বলছ? তুমি এখনও জানো না, আমি তোমার ভাগ্যে কতটা বাঁধা।”
ওদিকে, অর্ণব আয়নার জগতে হঠাৎ দেখতে পেল তার সামনে আরেক আয়না। আয়নার ভেতরে ফুটে উঠছে অদিতির ভবিষ্যৎ।
প্রথম দৃশ্য—অদিতি কাঁদছে, কিন্তু তার হাতে স্বপ্নফুল।
দ্বিতীয় দৃশ্য—অদিতি গ্রামে ফিরছে, মানুষ তাকে উপহাস করছে।
তৃতীয় দৃশ্য—অদিতি আরেকজন অচেনা পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, যার চোখ গভীর অন্ধকারে ভরা।
অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল।
“না… অদিতি অন্য কারও সাথে… এটা হতে পারে না।”
ঠিক তখনই অদৃশ্য কণ্ঠ বলল—
“তোমার ভালোবাসা কি এতটা বড় যে, তাকে অন্য কারও হাতে সুখী দেখতে পারবে?”
অর্ণব চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“যদি এটাই তার নিয়তি হয়, আমি তাকে বেঁধে রাখব না। আমি শুধু চাই, সে সুখী হোক।”
আয়নাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, আর আলো ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।
অদিতি ফুল হাতে পথিকের সামনে দাঁড়াল। ফুলটা হঠাৎ তার হাতের ভেতরে ঝলসে উঠল, আর পথিক মৃদু মাথা নাড়ল।
“তুমি প্রথম রহস্যের যোগ্য। কিন্তু সাবধান, সামনে পথ আরও কঠিন।
দ্বিতীয় রহস্য—অমাবস্যার ঘণ্টা। তা পাহারা দেয় এমন এক সত্তা, যার ডাক শুনলে সময় থেমে যায়।”
অদিতির শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
“আর আমি যদি সেই ঘণ্টা পাই?”
পথিক হাসল।
“তাহলে তুমি সময়কে ভাঙতে পারবে। কিন্তু মনে রেখো—যতক্ষণ তুমি ঘণ্টা বাজাবে, ততক্ষণ তোমার জীবন কমতে থাকবে।”
অদিতি আতঙ্কে শ্বাস রুদ্ধ করল, কিন্তু তারপরই দৃঢ় হলো।
“আমি প্রস্তুত।”
পথিক হঠাৎ কাছে এসে অদিতির চোখের দিকে তাকাল।
“তুমি জানো না, অদিতি, আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীর। তুমি যখন সপ্ত রহস্যের পথে এগোবে, আমাকে প্রতিবারই পাবে। আমি তোমার সহচরও, আবার প্রতিদ্বন্দ্বীও।”
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
“আপনি সত্যিই কে?”
লোকটা মৃদু হেসে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
শুধু তার কণ্ঠ ভেসে এল—
“একদিন বুঝবে।”
অদিতি তখনও স্বপ্নফুল শক্ত করে বুকে চেপে রেখেছিল।
রাতে অদিতি নদীর ধারে ফিরে এলো। আয়নার জলে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল—
“অর্ণব, আমি প্রথম রহস্য পেয়েছি। আমি থামব না। যতক্ষণ না তোমাকে ফেরাতে পারছি, আমি লড়ব।”
জলের ভেতর থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা উঠল, যেন অর্ণবের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“আমি তোমার ওপর ভরসা রাখি, অদিতি।”
অদিতির চোখ ভিজে গেল, কিন্তু তার কণ্ঠ দৃঢ়।
“এবার আমার পথ অমাবস্যার ঘণ্টার দিকে।”
( চলবে… )
