ভালোবাসার অতৃপ্ত আত্মা
- Abhijit Halder
গভীর রাত, ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢাকা। থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝলকানিতে আলোকিত হচ্ছে কলকাতার এক পুরোনো বাড়ি। বাড়ির প্রতিটি ইঁটে যেন লুকিয়ে আছে সহস্র স্মৃতি, দীর্ঘশ্বাস আর না বলা কথা। এই বাড়িরই এক কোণে, বিবর্ণ কাঠের সিঁড়ির শেষ ধাপে, প্রায়শই একটি আবছা অবয়ব দেখা যায়। কেউ বলে তা আলো-ছায়ার খেলা, কেউ বলে মনের ভুল, কিন্তু যারা দেখেছে, তাদের চোখে ভয় আর বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। এটি হলো মিতা, এক অতৃপ্ত আত্মা, যার ভালোবাসা আজও তাকে এই পৃথিবীতে আটকে রেখেছে।
বহু বছর আগে, সেই ব্রিটিশ আমলের কলকাতা, এই বাড়িতেই বাস করতো মিতা আর অনিকেত। তাদের প্রেম ছিল গভীর, নিবিড়, বসন্তের প্রথম ফুলের মতো সতেজ। অনিকেত ছিল এক স্বপ্নালু শিল্পী, তার তুলির টানে ক্যানভাসে প্রাণ পেত শহরের ব্যস্ত জনজীবন আর গঙ্গার শান্ত ঢেউ। মিতা ছিল এক প্রাণচঞ্চলা, হাস্যময়ী মেয়ে, যার প্রতিটি হাসি যেন অনিকেতের তুলিতে নতুন রঙ যোগ করত। তারা ছিল একে অপরের পরিপূরক। তাদের ভালোবাসার গল্প কেবল এই বাড়ির দেয়াল নয়, হাওড়া ব্রিজের লোহার কাঠামো থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মার্বেল পাথর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল।
তারা ঘন্টার পর ঘন্টা গঙ্গার ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখতো, হাতে হাত রেখে নিউ মার্কেটের ভিড়ে হারিয়ে যেত, আর ময়দানের সবুজ ঘাসে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতো। অনিকেত মিতাকে নিয়ে ছবি আঁকতো, আর মিতা মুগ্ধ চোখে তার শিল্পের প্রশংসা করতো। তাদের স্বপ্ন ছিল ছোট, কিন্তু গভীর — একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর, যেখানে অনিকেত তার আর্ট স্টুডিও তৈরি করবে, আর মিতা তার ছোট্ট হাতে বাগান সাজাবে। সেখানে কেবল থাকবে তারা দুজন আর তাদের অনাগত সন্তানেরা। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল, "মৃত্যু ছাড়া আর কিছু আমাদের আলাদা করতে পারবে না।" তাদের বিশ্বাস ছিল, তাদের ভালোবাসা এতটাই শক্তিশালী যে, মৃত্যুর পরেও তা অক্ষুণ্ণ থাকবে।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে, এক মর্মান্তিক ঝড়বৃষ্টির রাতে, তাদের দুজনেরই জীবনদীপ নিভে গেল। অনিকেত তখন এক জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছিল। মিতা অপেক্ষা করছিল তার জন্য, জানালার পাশে বসে, ঝড়ের করাল থাবার সাক্ষী হয়ে। এক পুরোনো জীর্ণ গাছের ডাল বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বাড়ির ছাদে পড়ল। মিতা অনিকেতকে খুঁজতে বের হলো, যখন সে দেখল, রাস্তার মাঝে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে আছে, আর অনিকেত তারই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে! মিতা চিৎকার করে অনিকেতকে ডাকল, তার দিকে ছুটে গেল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! অনিকেত তার দিকে ফিরতেই, একটি বিদ্যুতের তার তাদের দুজনের ওপরই পড়ল। মিতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে, তার শেষ দৃষ্টিতে ছিল অনিকেতের জন্য সীমাহীন ভালোবাসা আর না পাওয়ার বেদনা। আর অনিকেত চলে গেল এক শান্ত, গভীর ঘুমে, যেন সে কোনোদিন ঘুমিয়েই ওঠেনি। তাদের ভালোবাসা যেন এক নিদারুণ প্রহসনের শিকার হয়েছিল।
তাদের মৃত্যুর কয়েক বছর পর, মিতার আত্মা ফিরে এল। এক অস্থিরতা, এক অব্যক্ত বেদনা তাকে তাড়িয়ে ফিরছিল। সে অনুভব করতো, তার ভালোবাসার গল্পটা অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তার প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি শ্বাস ছিল অনিকেতের জন্য। কিন্তু অনিকেতের আত্মা মুক্তি পেয়েছিল, সে চলে গিয়েছিল অজানা এক শান্তিময় লোকে। হয়তো তার ভালোবাসা এতই পবিত্র ছিল যে, কোনো বাঁধন তাকে আটকাতে পারেনি। মিতা একা পড়ে রইল, তার ভালোবাসা তাকে অদৃশ্য শিকলে বেঁধে রাখল পৃথিবীর বুকে।
মিতার ভূতীয় অস্তিত্ব ছিল এক অদ্ভুত দুঃখের কারণ। সে দেখতো তার প্রিয় কলকাতা কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ঘোড়ার গাড়ির বদলে ছুটছে ট্রাম, তারপর এলো বাস আর গাড়ি। পুরোনো দালান ভেঙে তৈরি হচ্ছে আধুনিক অট্টালিকা। মানুষরা বদলে গেছে, তাদের ভাষা, পোশাক, জীবনযাপন সবকিছুই নতুন। মিতা ঘুরে বেড়াতো পুরনো বাড়ির আনাচে-কানাচে, পরিচিত রাস্তাগুলোতে, যেখানে তাদের ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সে দেখতে পেত তার প্রিয় গঙ্গার ঘাট, যেখানে তারা একসাথে সময় কাটাতো, এখন সেখানে কংক্রিটের জঙ্গল। তার মন কেবলই খুঁজে ফিরতো অনিকেতকে, সেই পরিচিত হাসি, সেই উষ্ণ স্পর্শ, যা একসময় তার জীবনের সবকিছু ছিল। সে ছিল একাকী, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ তার নাগালের বাইরে। তার জন্য কোনো গান ছিল না, কোনো স্পর্শ ছিল না, ছিল কেবলই এক সীমাহীন শূন্যতা। তার আত্মাকে ঘিরে ছিল এক শীতল, বিষণ্ণ হাওয়া, যা শুধু তারাই অনুভব করতে পারত, যারা তার খুব কাছাকাছি আসতো।
কয়েক দশক কেটে গেল। কলকাতার বুকে গড়ে উঠলো নতুন নতুন অট্টালিকা, বদলে গেল শহরের চেনা ছবি। কিন্তু মিতা রয়ে গেল সেই অতীতের ছায়ায়। তার আত্মা এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে দিন কাটাতো, বা বলা ভালো, রাত কাটাতো। এক গভীর বিষণ্ণতা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সে জানতো অনিকেত আর ফিরে আসবে না, কিন্তু তার মন তা মানতে চাইতো না। তার অবিনশ্বর ভালোবাসাই তাকে এই পৃথিবীতে ধরে রেখেছিল।
একদিন, এক আধুনিক ক্যাফেতে, মিতা দেখতে পেল এক যুবককে। তার নাম রাতুল। রাতুল ছিল এক সাধারণ ছেলে, এক নতুন যুগের প্রতীক। সে সদ্য এই শহরে এসেছে নতুন চাকরি নিয়ে, নিজের স্বপ্ন পূরণের আশায়। এক মেঘলা বিকেলে সে যখন পার্কের এক বেঞ্চে বসে বই পড়ছিল, তখন সে মিতাকে প্রথম ‘দেখলো’। মিতা এক হালকা ফিনফিনে শাড়িতে তার পাশে এসে বসলো। রাতুল তাকে দেখে এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হলো। মিতার চোখজোড়া যেন হাজারো গল্প বলছিল, তার হাসি ছিল বিষণ্ণতায় ভরা এক মায়াবী হাসি। রাতুল বুঝতে পারছিল না কেন, কিন্তু এই অপরিচিতা মেয়েটির প্রতি তার এক গভীর আকর্ষণ অনুভব করছিল। মিতা ঠিক অনিকেতের মতোই হাসছিল, অনিকেতের মতোই তার চলন, তার চোখের গভীরতা! মিতার হৃদয়ে এক অব্যক্ত দোলা লাগলো। তার অবিনশ্বর আত্মা এক তীব্র আকর্ষণে রাতুলের দিকে ছুটে গেল। সে ভাবতে শুরু করলো, এই বুঝি অনিকেত ফিরে এসেছে, অন্য রূপে, অন্য নামে। তার মনে হলো, নিয়তি বুঝি তাকে আরেকবার সুযোগ দিয়েছে তার অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্পটা সম্পূর্ণ করার।
তাঁরা দেখা করতে শুরু করলো। মিতা এমনভাবে কথা বলতো যেন তারা বহুদিনের চেনা। সে অনিকেতের সব প্রিয় খাবার, প্রিয় গান, এমনকি তার ছোট ছোট অভ্যাসগুলোও রাতুলের সাথে মেলাতে শুরু করলো। রাতুল অবাক হতো, কিন্তু সে ভাবতো এ হয়তো নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার। মিতা যেন রাতুলের মনের কথা বলতে পারতো, তার না বলা স্বপ্নগুলোও জানতো। রাতুল মিতার সঙ্গ উপভোগ করতো, তার নিঃসঙ্গ জীবনে যেন এক নতুন রঙ লেগেছিল। রাতুল ছিল একা, শহরের কোলাহলে হারিয়ে যাওয়া এক যুবক, আর মিতা তার কাছে ছিল এক শান্ত আশ্রয়।
মিতার জন্য সময় যেন থমকে গিয়েছিল। সে রাতুলকে অনিকেত ভেবেই ভালোবাসতো। রাতুল যখন মিতার হাত ছুঁতো, মিতা এক শীতল পরশ অনুভব করতো, কিন্তু তার কাছে তা ছিল ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শ। তারা সিনেমা দেখতে যেত, ক্যাফেতে গল্প করতো, এমনকি তারা একসাথে ঘুরতে যেত সেইসব জায়গায় যেখানে মিতা আর অনিকেত তাদের অতীতের দিনগুলো কাটিয়েছিল। রাতুল মাঝে মাঝে মিতার অদ্ভুত আচরণে কিছুটা খটকা খেতো। মিতা কখনো নিজের অতীতের কথা বলতো না, রাতুল তার পরিবার বা বন্ধুদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত। তার পোশাক ছিল পুরোনো ধাঁচের, যেন সে অন্য কোনো সময়ের মেয়ে। তার কণ্ঠস্বর ছিল এক অদ্ভুত মায়াভরা, যেন বাতাসে মিশে থাকা এক সুর। রাতুল এতই মোহাচ্ছন্ন ছিল যে, সে এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতো না। সে ভাবতো, হয়তো মিতা একটু রহস্যময়ী, আর এই রহস্যই তাকে আরও বেশি আকর্ষণ করতো।
মিতা রাতুলের জীবনে মিশে গিয়েছিল। রাতুল তার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে মিতার কথা বলতো। তারা জিজ্ঞাসা করতো মিতার পরিবার সম্পর্কে, মিতার বাসস্থান সম্পর্কে। রাতুল সবসময়ই অস্পষ্ট উত্তর দিত, কারণ মিতা এসব নিয়ে কথা বলতে চাইতো না। রাতুল নিজেই ভাবতো, মিতা হয়তো খুব স্বাধীনচেতা এক মেয়ে, যে নিজের ব্যক্তিগত জীবন গোপন রাখতে ভালোবাসে। তাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। রাতুল মিতার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তকে গ্রীষ্মের দিনে স্বস্তির বাতাসের মতো মনে করতো। মিতা যেন তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যেত, যেখানে সময় থেমে যেত, কেবল তাদের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু অস্তিত্বে থাকতো না।
একদিন গভীর রাতে, রাতুল তার পুরোনো বন্ধু সুমনের সাথে কথা বলছিল ফোনে। সুমন ছিল তার কলেজ জীবনের বন্ধু, যার সাথে সে সবকিছু ভাগ করে নিতো। রাতুল মিতার কথা বলছিল, "জানিস সুমন, ওর সাথে যখন থাকি, তখন মনে হয় যেন অনেক চেনা, সব কিছু পরিচিত লাগে। ও যেন আমার সব কথা বোঝে। মনে হয় যেন পূর্বজন্মের সম্পর্ক।" সুমন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "কেমন দেখতে রে তোর প্রেমিকা? কোথায় থাকে?" রাতুল যখন মিতার বর্ণনা দিচ্ছিল — লম্বা, ফিনফিনে শাড়ি, বড় কালো চোখ, আর গঙ্গার ধারে সেই পুরোনো বাড়িটার কাছের এক গলিতে থাকে — তখন তার বন্ধু হঠাৎ চুপ করে গেল। সুমনের গলার স্বর বদলে গেল। সে ফিসফিস করে বললো, "রাতুল, তুই কি মিতার কথা বলছিস? সেই পুরোনো বাড়িটার কাছে যে থাকে? সে তো বহু বছর আগে মারা গেছে ওই পুরোনো বাড়িটাতে! একটা এক্সিডেন্টে... তার আত্মা আজও নাকি ওখানেই ঘুরে বেড়ায়।"
রাতুল হাসতে হাসতে বললো, "কি বলছিস! মিতা তো আমার সাথেই আছে! এই তো সে এখন আমার পাশেই শুয়ে আছে, ঘুমাচ্ছে!"
কথা শেষ হওয়ার আগেই বিদ্যুতের ঝলকানি হলো। আলো নিভে গেল। রাতুল অনুভব করলো এক তীব্র শীতলতা, যেন ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে নেমে গেছে অনেকটাই। তার পাশে শুয়ে থাকা মিতার অস্তিত্ব যেন হঠাৎ করেই শীতল, অপ্রাকৃতিক হয়ে উঠেছে। সে শুনতে পেল এক চাপা কান্নার শব্দ, যা তার হৃদয়ের গভীরে এক ভয়ংকর কম্পন সৃষ্টি করলো। তার শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। সে নিজের মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে টর্চ জ্বালাতেই, তার চোখের সামনে যে দৃশ্যটা ভেসে উঠলো, তাতে তার আত্মা শুকিয়ে গেল।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক আবছা, প্রায় স্বচ্ছ অবয়ব। মিতা, যাকে সে ভালোবাসতো, যার সাথে সে দিনের পর দিন কাটিয়েছিল, সে ছিল না রক্ত-মাংসের মানুষ। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জলের ধারা, যা ছিল না কোনো সত্যিকারের অশ্রু, কেবলই এক বিষণ্ণ জলীয় বাষ্প। তার মুখটি ছিল করুণ, আতঙ্কিত। সে ছিল এক ভূত, এক অতৃপ্ত আত্মা, যার ভালোবাসা তাকে এই পৃথিবীতে আটকে রেখেছে। রাতুল দেখল, তার প্রেমিকা নেই, আছে শুধু এক ভয়ংকর সত্তা।
রাতুল ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো। তার পৃথিবী যেন এক লহমায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যে ভালোবাসাকে সে সত্যি ভেবেছিল, তা ছিল এক মায়া, এক ছলনা। মিতা তার দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকালো। তার মুখে ছিল না কোনো রাগ, ছিল কেবলই এক গভীর শোক। রাতুল দেখতে পেল, মিতা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে যেন দীর্ঘ দিনের পরিচিত মুখটা মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসের সাথে, তার বিষণ্ণ কান্নার শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।
পরের দিন সকালে, রাতুলকে পাওয়া গেল বিছানায় অচেতন অবস্থায়। তার জ্বর হয়েছিল, সে প্রলাপ বকছিল। তার বন্ধুরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তাররা শারীরিক কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না, কিন্তু রাতুল মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ছিল। যখন সে সুস্থ হলো, তখন তার জীবনে সব কিছু বদলে গিয়েছিল। সে আর সেই পুরোনো রাতুল ছিল না। তার চোখে ছিল এক গভীর বিষণ্ণতা, এক অজানা ভয়। সে বুঝেছিল, ভালোবাসার কিছু গল্প মৃত্যুর পরেও শেষ হয় না, কিছু আত্মা কেবলই খুঁজে ফেরে তাদের হারানো সঙ্গীকে, আর সেই খোঁজা কখনো কখনো জীবিতদের জীবনে এনে দেয় এক অদ্ভুত অন্ধকার।
রাতুল সেই পুরোনো বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, কলকাতা ছেড়ে অন্য এক শহরে পাড়ি জমালো। সে চেষ্টা করলো সব কিছু ভুলে যেতে। কিন্তু মিতার স্মৃতি, তার সেই অতৃপ্ত ভালোবাসা, এক অদৃশ্য অভিশাপের মতো তাকে তাড়িয়ে ফিরতো। সে আর কখনো কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি, কারণ তার মন সর্বদা সেই শীতল, মায়াবী স্পর্শের ভয় পেত। সে জানতো, এই ঘটনা কাউকে বলতে পারবে না, কারণ কেউ বিশ্বাস করবে না। তাকে আজীবন এই সত্যের বোঝা বয়ে চলতে হবে, একাকী।
মিতার আত্মা আর কখনো রাতুলের কাছে ফিরে আসেনি। সে হয়তো বুঝেছিল, তার ভালোবাসা আর এই পৃথিবীতে কারো জন্য নয়। সে আজও ঘুরে বেড়ায় সেই পুরোনো বাড়ির চারপাশে, সেইসব রাস্তাঘাটে, যেখানে অনিকেতের সাথে তার ভালোবাসার স্মৃতি মিশে আছে। প্রতি রাতে, সেই পুরোনো সিঁড়ির শেষ ধাপে, একটি আবছা অবয়ব বসে থাকে, একাকী, তার হারানো ভালোবাসার অনন্ত অপেক্ষায়। আর রাতুল, সে শুধু অপেক্ষা করে, কবে তার নিজের মুক্তি আসবে, কবে সে এই ভয়াবহ স্মৃতির হাত থেকে রেহাই পাবে। ভালোবাসা যেখানে অতৃপ্ত, সেখানে মুক্তিও যেন এক অধরা স্বপ্ন। মিতা আর অনিকেতের ভালোবাসা, যা একসময় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি, আজ তা পরিণত হয়েছে এক চিরস্থায়ী বিষাদগাথায়, যা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও, তাদের অতৃপ্ত আত্মা আজও এই কলকাতার বুকে এক ভয়ংকর সত্য হয়ে বেঁচে
আছে।
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder