প্রথম অংশ
নিউ ইংল্যান্ডের নির্জন গ্রাম ব্ল্যাকউড, তার শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল এক প্রাচীন অভিশাপ। এখানকার বাসিন্দারা বিশ্বাস করত, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাইলেন্ট রিভারের গভীর থেকে উঠে আসে এক অশুভ শক্তি, যা প্রতি বছর গ্রীষের শেষ লগ্নে কেড়ে নেয় গ্রামেরই কোনো এক গর্ভবতী মায়ের প্রাণ। এই বছর সেই অভিশাপের শিকার হলেন এলিনা, যিনি তার স্বামীর সাথে শহরের কোলাহল ছেড়ে ব্ল্যাকউডের শান্ত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এলিনার স্বামী, ডেভিড, একজন স্বনামধন্য ডাক্তার। সে ব্ল্যাকউডের একমাত্র ক্লিনিকে কাজ শুরু করেছিল। গর্ভবতী এলিনা ব্ল্যাকউডের শান্ত পরিবেশ খুব উপভোগ করত, কিন্তু তার আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হলো না।
একদিন সন্ধ্যায়, ডেভিড যখন ক্লিনিক থেকে ফিরছিল, তখন সে এলিনাকে তাদের বাগানের পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল। তার মুখ ছিল ফ্যাকাশে, আর শরীরে ছিল গভীর ক্ষতচিহ্ন, যেন তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে আঁচড়ানো হয়েছে। ডেভিড দ্রুত এলিনাকে ক্লিনিকে নিয়ে গেল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। এলিনা এবং তার অনাগত সন্তান – দুজনেই মারা গিয়েছিল। ডাক্তাররা কোনো স্পষ্ট কারণ খুঁজে পেল না, শুধু জানাল, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এলিনার মৃত্যু হয়েছে। ডেভিড শোকে পাথর হয়ে গেল। সে ব্ল্যাকউডের এই অশুভ অভিশাপ সম্পর্কে কিছুই জানত না, আর এই মর্মান্তিক ঘটনা তার জীবনকে এক নতুন মোড় ঘুরিয়ে দিল।
এলিনার মৃত্যুর পর ডেভিডের জীবনে নেমে আসে গভীর অন্ধকার। সে ব্ল্যাকউডের এই রহস্যময় মৃত্যুর কারণ খুঁজতে মরিয়া হয়ে ওঠে। গ্রামের বয়স্করা ফিসফিস করে বলত, এটা ব্ল্যাকউডের প্রাচীন অভিশাপ, যা একজন গর্ভবতী মহিলার আত্মার প্রতিশোধ। ডেভিড এই কুসংস্কার মানতে নারাজ। সে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজছিল। কিন্তু যত সে গভীরে প্রবেশ করছিল, তত সে বুঝতে পারছিল, এর পেছনে কোনো সাধারণ কারণ নেই।
একদিন ডেভিড তার লাইব্রেরিতে ব্ল্যাকউডের পুরনো নথি ঘাঁটতে গিয়ে একটি ডায়েরি খুঁজে পেল। ডায়েরিটি লেখা হয়েছিল প্রায় দুশো বছর আগে, ব্ল্যাকউডের প্রথম দিকের একজন বাসিন্দা, এলিজাবেথ দ্বারা। এলিজাবেথ ছিলেন একজন ধাত্রী। ডায়েরিতে সে ব্ল্যাকউডের অভিশাপের কথা লিখেছিল। এলিজাবেথ লিখেছিল, "প্রতি বছর গ্রীষ্মের শেষ লগ্নে, যখন চাঁদ পূর্ণ হয়, তখন এক অভিশপ্ত আত্মা ব্ল্যাকউডের গর্ভবতী নারীদের শিকার করে। এই আত্মা ছিল একজন গর্ভবতী নারী, যাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।" ডেভিড আরও পড়তে লাগল। ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল, "এই আত্মার নাম 'মার্থা'। সে তার অনাগত সন্তানের সাথে মারা গিয়েছিল। সে চায় না অন্য কোনো গর্ভবতী নারী তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখুক।" ডেভিডের গা শিউরে উঠল। সে বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ খুন নয়, বরং এক অশরীরী আত্মার প্রতিশোধ।
ডায়েরিতে মার্থার গল্প পড়ে ডেভিডের চোখ ছলছল করে উঠল। মার্থা ছিল ব্ল্যাকউডের এক সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে, যে ছিল অনাথ। গ্রামের চার্চের ফাদার তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মার্থা প্রেমে পড়েছিল গ্রামেরই এক কাঠুরিয়ার সাথে, যার নাম ছিল জোনাথান। তাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে মার্থা গর্ভবতী হয়। জোনাথান মার্থাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু গ্রামে তখন এক কঠিন নিয়ম ছিল, যদি কোনো মেয়ে বিয়ের আগে গর্ভবতী হয়, তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হত। জোনাথান ভয় পেয়ে মার্থাকে একা ফেলে পালিয়ে যায়।
মার্থা সাহায্যের জন্য গ্রামের ফাদারের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু ফাদার তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেন। লজ্জায়, অপমানে এবং অসহায়ত্বের এক গভীর মুহূর্তে মার্থা সাইলেন্ট রিভারের পাশে একাকী জঙ্গলে প্রবেশ করে। সেখানে, প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তার এবং তার অনাগত সন্তানের মৃত্যু হয়। ডায়েরিতে লেখা ছিল, মার্থার মৃত্যুর পর তার আত্মা ব্ল্যাকউডের মাটি আঁকড়ে ধরেছিল, প্রতিশোধের নেশায়। সে অনুভব করেছিল তার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। মার্থা প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে সুখ তার ভাগ্যে জোটেনি, সে সুখ সে অন্য কাউকে পেতে দেবে না।
মার্থার করুণ কাহিনি জেনে ডেভিড প্রতিজ্ঞা করল, সে এই অশুভ আত্মার হাত থেকে ব্ল্যাকউডকে রক্ষা করবে। সে বুঝতে পারল, মার্থার আত্মা কেবল তখনই শান্ত হবে, যখন তার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ হবে – অর্থাৎ তার অনাগত সন্তানের প্রতি ন্যায়বিচার হবে। ডেভিড লাইব্রেরিতে আরও প্রাচীন বই খুঁজতে লাগল, যেখানে অশরীরী আত্মাদের শান্ত করার উপায় লেখা থাকতে পারে। সে পুরনো লোককথা, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির ভূতাত্ত্বিক গবেষণা পড়তে লাগল।
একসময় সে একটি প্রাচীন বইতে জানতে পারল, যে আত্মারা প্রতিশোধের জন্য ঘুরছে, তাদের শান্ত করার জন্য একটি বিশেষ আচার পালন করতে হয়। এই আচারটি ছিল মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানানো এবং একটি প্রতীকী সৎকার করা। ডেভিড গ্রামের বয়স্কদের সাথে কথা বলল। প্রথমে তারা তাকে বিশ্বাস করতে চাইল না, কিন্তু ডেভিডের দৃঢ় সংকল্প দেখে তারা শেষ পর্যন্ত রাজি হলো। গ্রামের সবচেয়ে জ্ঞানী মহিলা, এলিজাবেথ (যিনি ডায়েরির লেখক নন, তিনি ব্ল্যাকউডের প্রবীণতম অধিবাসী), ডেভিডকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তিনি ব্ল্যাকউডের অশুভ শক্তির সম্পর্কে বহু প্রাচীন লোককথা জানতেন। তিনি ডেভিডকে মার্থার আত্মার শান্তির জন্য একটি প্রাচীন আচারের কথা বললেন। ডেভিড এবং এলিজাবেথ দুজনেই এই কাজ শুরু করল।
ডেভিড এবং এলিজাবেথ মার্থার আত্মার শান্তির জন্য আচার পালনের সিদ্ধান্ত নিল। তারা সাইলেন্ট রিভারের পাশে, যেখানে মার্থার মৃত্যু হয়েছিল, সেখানে একটি ছোট প্রতীকী কবর তৈরি করল। তারা মার্থার অনাগত সন্তানের জন্য একটি ছোট পুতুল এবং কিছু খেলনা রাখল, যা তার অকালপ্রয়াত সন্তানের প্রতীক। এলিজাবেথ প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন, আর ডেভিড ভক্তিভরে প্রার্থনা করল। তারা মার্থার আত্মার কাছে ক্ষমা চাইল এবং তার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণের জন্য প্রতিজ্ঞা করল।
আচার চলাকালীন, ব্ল্যাকউডের বাতাস হঠাৎ করে শীতল হয়ে উঠল। একটি অদ্ভুত ফিসফিস শব্দ শোনা গেল, যেন বাতাস মার্থার কথা বলছে। ডেভিড অনুভব করতে পারল, তার চারপাশে এক অদৃশ্য শক্তি বিচরণ করছে। ধীরে ধীরে, বাতাস শান্ত হয়ে এল, আর ফিসফিস শব্দ থেমে গেল। একটি অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ল ব্ল্যাকউডের পরিবেশে। যেন মার্থার আত্মা অবশেষে মুক্তি পেল।
দ্বিতীয় অংশ
মার্থার আত্মার মুক্তির পর ব্ল্যাকউডে শান্তি ফিরে এলেও, ডেভিডের মনে এক নতুন প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। মার্থার আত্মা মুক্তি পেলেও, এলিনার ক্ষতচিহ্নগুলো তাকে বিচলিত করত। মার্থা তো গর্ভবতী মহিলাদের শিকার করত, কিন্তু এলিনার শরীরের ক্ষতচিহ্নগুলো কি কেবল মার্থার প্রতিশোধের ফলাফল ছিল? ডেভিড আরও গভীরে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিল। সে এলিনার পুরোনো কেস ফাইলগুলো আবার খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
ডেভিড লক্ষ্য করল, এলিনার শরীরে যে ক্ষতচিহ্নগুলো ছিল, সেগুলো কোনো মানুষের নখের মতো ছিল না, বরং আরও সূক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ণ ছিল, যেন কোনো ধারালো যন্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মার্থার ডায়েরিতে এমন কোনো কিছুর উল্লেখ ছিল না। ডেভিড ব্ল্যাকউডের পুরোনো নথি এবং স্থানীয় লোককথা ঘাঁটতে গিয়ে এক নতুন তথ্য পেল। বহু বছর আগে, ব্ল্যাকউডের সাইলেন্ট রিভারের পাশেই একটি ছোট কুটির ছিল, যেখানে একজন বৃদ্ধ ধাত্রী বাস করতেন। তার নাম ছিল সারাহ। সারাহ ছিলেন একজন ভেষজবিদ এবং গ্রামে তার সুনাম ছিল। কিন্তু একসময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং গ্রামের গর্ভবতী মহিলাদের উপর অদ্ভুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করত, সারাহর হাতে অনেক গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয়েছিল।
ডেভিডের মনে হলো, এলিনার মৃত্যুর পেছনে কেবল মার্থার আত্মা নয়, অন্য কোনো রহস্যও লুকিয়ে আছে। সে এলিজাবেথকে সারাহর কথা জিজ্ঞেস করল। এলিজাবেথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "সারাহর কথা ব্ল্যাকউডের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়। সে তার নিজের হাতে অনেক মায়ের জীবন কেড়েছিল, যারা মার্থার অভিশাপ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু সারাহর নিষ্ঠুরতা মার্থার প্রতিশোধকেও হার মানিয়েছিল।" ডেভিড বুঝতে পারল, ব্ল্যাকউডের অভিশাপের স্তর আরও গভীর। সে প্রতিজ্ঞা করল, এলিনার মৃত্যুর পেছনের সমস্ত সত্য সে উন্মোচন করবে, এমনকি যদি এর জন্য তাকে আরও অন্ধকার রহস্যের মুখোমুখি হতে হয়। ব্ল্যাকউড হয়তো মার্থার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিল, কিন্তু তার গভীরে লুকিয়ে ছিল আরও অনেক অব্যক্ত বেদনা এবং অকথিত গল্প, যা হয়তো কোনোদিনও পুরোপুরি সমাধান হবে না।
সারাহর রহস্য উন্মোচন করতে ডেভিড বদ্ধপরিকর হলো। সে গ্রামের প্রবীণদের কাছ থেকে সারাহর পুরনো কুটিরের ঠিকানা জানতে পারল। কুটিরটি সাইলেন্ট রিভারের আরও গভীরে, এক ঘন জঙ্গলের ভেতরে অবস্থিত ছিল। দিনের বেলাতেও জায়গাটা ছিল ভুতুড়ে আর ছমছমে। ডেভিড একা গেল না; সে গ্রামের দু'জন সাহসী যুবক, জন ও পিটারকে সাথে নিয়ে গেল। তারা টর্চ আর কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে সারাহর পরিত্যক্ত কুটিরের দিকে রওনা হলো।
কুটিরের কাছে পৌঁছাতেই এক অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাস তাদের ঘিরে ধরল। দরজার পাল্লাগুলো ভাঙা, আর জানালাগুলো মাকড়সার জালে ঢাকা। ভেতরে প্রবেশ করতেই পচা আর ভেতরের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাদের নাকে এসে লাগল। আসবাবপত্রগুলো ধুলোয় ঢাকা, আর মেঝেতে ভাঙা কাঁচের টুকরা আর পুরোনো শিশি-বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ডেভিডের চোখ গেল একটা ভাঙা টেবিলের ওপর, যেখানে কিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি আর পুরোনো খাতার ছেঁড়া পাতা পড়েছিল।
সে একটা পাতা হাতে নিয়ে দেখল, তাতে গর্ভবতী মহিলাদের দেহের ছবি আঁকা এবং কিছু দুর্বোধ্য প্রতীক লেখা। ডেভিডের গা শিউরে উঠল।
পেছনের একটা ছোট ঘরে ডেভিড একটা লোহার বিছানা দেখতে পেল, যেখানে শেকল দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা ছিল। পাশে পড়ে ছিল মরিচা ধরা কিছু অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম। ডেভিড বুঝতে পারল, সারাহ এখানে গর্ভবতী মহিলাদের ওপর ভয়ংকর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত।
এলিনার শরীরের ক্ষতচিহ্নগুলো এই ধরনের কোনো যন্ত্রের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছিল বলে তার মনে হলো। ডেভিডের মনে সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো সারাহর আত্মা কি এখনো এই কুটিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নাকি তার কাজের পেছনে অন্য কোনো রহস্য ছিল? ডেভিড আরও কিছু খাতা খুঁজে দেখল, কিন্তু সেগুলো এতটাই জীর্ণ ছিল যে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। ডেভিডের মনে হলো, ব্ল্যাকউডের অভিশাপ কেবল এক প্রতিশোধপরায়ণ আত্মা নয়, বরং মানুষের অন্ধকার মনের এক ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি।
সারাহর কুটিরে পাওয়া সূত্র ডেভিডের অনুসন্ধানের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সে বুঝতে পারছিল, এলিনার মৃত্যু শুধুমাত্র মার্থার আত্মার কাজ ছিল না, বরং সারাহর মতো কোনো মানব সত্তার ভয়াবহ কীর্তিও এর পেছনে জড়িত থাকতে পারে। ডেভিড এবার এলিনার মৃত্যুর আগের দিনগুলোর ঘটনা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। সে এলিনার ব্যক্তিগত ডায়েরিটা আবার পড়া শুরু করল, যেটা সে শোকে এত দিন ছুঁয়েও দেখেনি।
এলিনার ডায়েরিতে লেখা ছিল, মৃত্যুর কয়েক দিন আগে সে ব্ল্যাকউডের বনের গভীরে এক অদ্ভুত মহিলার দেখা পেয়েছিল। মহিলাটির পরনে ছিল পুরোনো দিনের পোশাক, আর তার চোখ ছিল অস্বাভাবিক রকমের স্থির। মহিলাটি নিজেকে একজন ভেষজবিদ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল এবং এলিনাকে তার গর্ভাবস্থার কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বিশেষ পানীয় দিয়েছিল। এলিনা প্রথমদিকে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও, মহিলার মিষ্টি কথায় মুগ্ধ হয়ে সেই পানীয় পান করেছিল। এরপর থেকেই এলিনার শরীরে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। সে দুর্বল বোধ করতে শুরু করে এবং তার পেটে হালকা ব্যথা অনুভব করত। এলিনা ডায়েরিতে লিখেছিল, "আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন আমার নিজের শরীরেই বন্দি হয়ে যাচ্ছি। এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।"
ডেভিডের মনে প্রশ্ন জাগল, এই মহিলা কি তবে সারাহ ছিল? কিন্তু সারাহ তো বহু বছর আগে মারা গেছে! তবে কি সারাহর আত্মা এখনো ব্ল্যাকউডের বনে ঘুরে বেড়ায় এবং গর্ভবতী মহিলাদের প্রলুব্ধ করে? ডেভিডের মনে সন্দেহ আরও বাড়তে লাগল। সে বুঝতে পারল, ব্ল্যাকউডের অভিশাপ কেবল এক আত্মার প্রতিশোধ নয়, বরং দীর্ঘদিনের পুরোনো এক অশুভ চক্র, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্ল্যাকউডের বুকে চেপে বসে আছে। ডেভিড প্রতিজ্ঞা করল, সে এই অশুভ চক্রের মূল খুঁজে বের করবে এবং ব্ল্যাকউডকে এই অভিশাপ থেকে চিরতরে মুক্ত করবে। এলিনার শেষ মুহূর্তের কষ্ট ডেভিডকে আরও বেশি করে এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে উৎসাহিত করল।
এলিনার ডায়েরির সূত্র ধরে ডেভিডের মনে সন্দেহ আরও দানা বাঁধল। সে বুঝতে পারছিল, সারাহ শুধু একজন ভারসাম্যহীন ধাত্রী ছিলেন না, তার কাজের পেছনে আরও গভীর কোনো উদ্দেশ্য ছিল। ডেভিড এলিজাবেথের কাছে ফিরে গেল, সারাহ সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে। এলিজাবেথ প্রথমে ইতস্তত করলেও, ডেভিডের দৃঢ় সংকল্প দেখে মুখ খুললেন।
এলিজাবেথ বললেন, "সারাহ ছিল একজন অসাধারণ ধাত্রী, কিন্তু তার নিজের কোনো সন্তান ছিল না। এই শূন্যতা তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল। সে বিশ্বাস করত, গর্ভবতী মহিলাদের রক্তে এমন এক শক্তি আছে যা অমরত্ব দিতে পারে, বা অন্তত দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করতে পারে। সে মার্থার গল্প শুনেছিল, এবং মার্থার অকালপ্রয়াত সন্তানের ক্ষমতা তাকে আকর্ষণ করেছিল। সারাহ ভেবেছিল, যদি সে গর্ভবতী মায়েদের কাছ থেকে সেই শক্তি আহরণ করতে পারে, তাহলে সে নিজের জন্য একটি নতুন জীবন তৈরি করতে পারবে, হয়তো একটি সন্তানও!"
এলিজাবেথ আরও জানালেন, সারাহ একসময় গ্রামেরই একজন কালো জাদুকরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। সেই জাদুকর তাকে গর্ভবতী মহিলাদের ওপর অশুভ আচার পালনের পদ্ধতি শিখিয়েছিল, যার মাধ্যমে সে তাদের জীবনশক্তি শোষণ করতে পারত। এই প্রক্রিয়ায় যে ক্ষতচিহ্নগুলো তৈরি হত, সেগুলো সাধারণ আঘাতের মতো ছিল না, বরং ছিল এক ধরনের আত্মিক শোষণের চিহ্ন। এলিনার শরীরে দেখা ক্ষতগুলো ছিল সেই প্রমাণ। ডেভিডের মনে হলো, ব্ল্যাকউডের অভিশাপ আসলে দ্বি-স্তরীয়। প্রথমত, মার্থার প্রতিশোধপরায়ণ আত্মা, যা কেবল গর্ভবতী মহিলাদের শিকার করত। দ্বিতীয়ত, সারাহর অশুভ জাদু এবং জীবনশক্তি শোষণের আকাঙ্ক্ষা, যা মার্থার অভিশাপকে এক নতুন, আরও ভয়ংকর রূপ দিয়েছিল। ডেভিড বুঝতে পারল, ব্ল্যাকউডকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে হলে তাকে এই দুটি অশুভ শক্তিকেই মোকাবিলা করতে হবে।
ডেভিডের কাছে ব্ল্যাকউডের অভিশাপের দুটি দিক এখন স্পষ্ট – মার্থার প্রতিশোধপরায়ণ আত্মা এবং সারাহর জীবনশক্তি শোষণের অশুভ জাদু। সে বুঝতে পারল, এই দুটি শক্তিকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এলিজাবেথের সাহায্যে ডেভিড এক প্রাচীন আচারের কথা জানতে পারল, যা একই সাথে আত্মাকে শান্ত করতে এবং অশুভ জাদুর প্রভাব নিষ্ক্রিয় করতে পারে। এই আচারের জন্য কিছু বিশেষ উপাদান প্রয়োজন ছিল, যা ব্ল্যাকউডের বনের গভীরে বিরল স্থানে পাওয়া যেত।
ডেভিড, জন এবং পিটারকে সাথে নিয়ে সেই উপাদানগুলো সংগ্রহ করতে গেল। এক ভয়ঙ্কর রাতে, যখন চাঁদ পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত, ডেভিড এলিজাবেথকে নিয়ে সারাহর পরিত্যক্ত কুটিরের দিকে রওনা হলো। কুটিরের ভেতরে প্রবেশ করতেই এক হিমশীতল বাতাস তাদের ঘিরে ধরল। মনে হলো সারাহর অশুভ আত্মা এখনো তার সৃষ্টি করা বিভীষিকার মধ্যে আটকে আছে। এলিজাবেথ মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করলেন, আর ডেভিড কুটিরের কেন্দ্রে, যেখানে সারাহ তার অশুভ আচারগুলো করত, সেখানে সংগৃহীত উপাদানগুলো দিয়ে একটি প্রতীকী বেদি স্থাপন করল।
মন্ত্র উচ্চারণের সাথে সাথে কুটিরের ভেতরে ঝড় উঠতে শুরু করল। ভাঙা জানালাগুলো দিয়ে বাতাস হু হু করে প্রবেশ করতে লাগল, আর পুরোনো আসবাবপত্র নড়তে শুরু করল। এক ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ভেসে আসল, যা সারাহর আত্মার যন্ত্রণা এবং ক্রোধের প্রকাশ। ডেভিড অনুভব করল, সারাহর অশুভ শক্তি মার্থার আত্মার সাথে মিশে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এলিজাবেথ ডেভিডকে নির্দেশ দিলেন, "তার অশুভ কাজের চিহ্নগুলো ধ্বংস করো!" ডেভিড তখন সারাহর সেই ভাঙা টেবিল এবং অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামগুলো ভেঙে দিতে শুরু করল, যা তার নিষ্ঠুরতার প্রতীক ছিল।
যখন শেষ যন্ত্রটি ভাঙল, তখন এক তীব্র আলোর ঝলকানি দেখা গেল এবং তারপরই সব শান্ত হয়ে গেল। কুটিরের ভেতরে পরিবেশ আগের থেকে অনেক হালকা হয়ে গেল। মনে হলো যেন শত বছরের জমাট অন্ধকার দূর হয়ে গেছে। ডেভিড এবং এলিজাবেথ অনুভব করতে পারলেন, সারাহর অশুভ শক্তি এবং মার্থার প্রতিশোধপরায়ণ আত্মা – দুটিই ব্ল্যাকউড থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে।
পরের দিন সকালে ব্ল্যাকউডের আকাশে এক নতুন সূর্য উঠল। ডেভিডের মনে হলো যেন এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন থেকে ব্ল্যাকউড জেগে উঠেছে। সে সিদ্ধান্ত নিল, ব্ল্যাকউডেই থেকে যাবে। সে তার জীবনের বাকিটা সময় ব্ল্যাকউডের মানুষদের সাহায্য করার জন্য উৎসর্গ করবে। সে বুঝতে পারল, কিছু ক্ষত সহজে সারে না, কিন্তু সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে সবচেয়ে গভীর অন্ধকারকেও দূর করা যায়। ব্ল্যাকউড আর কখনো গর্ভবতী মায়ের অভিশাপের শিকার হয়নি। মার্থা এবং সারাহর গল্প ব্ল্যাকউডের ইতিহাসে এক গভীর শিক্ষা হয়ে রইল, যা তাদের মনে করিয়ে দেয় মানবতা এবং মমত্ববোধের গুরুত্ব। ব্ল্যাকউডে
র বাতাস এখন কেবল শান্তির দীর্ঘশ্বাস বয়ে আনে, আর সেই দীর্ঘশ্বাসই বলে দেয়, অভিশাপ থেকে মুক্তির গল্প।
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder