প্রাচীন চিরকুটের রহস্য
- অভিজিৎ হালদার •••
আকাশে তখন গভীর ধূসর মেঘের আনাগোনা। মিশেল আর লিয়াম, দুজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী, আয়ারল্যান্ডের ক্লিফ অফ মোহেরের এবড়োখেবড়ো পথ ধরে হেঁটে চলেছিল। হিমেল হাওয়া তাদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল, আর নিচে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন এক অদ্ভুত মাদকতা তৈরি করছিল। তাদের গন্তব্য ছিল ক্লিফের একদম শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটি প্রাচীন বাতিঘর, যেখানে সূর্যাস্তের এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা যায় বলে মিশেল শুনেছিল।
লিয়াম অবশ্য প্রাকৃতিক দৃশ্যের চেয়েও বেশি আগ্রহী ছিল নতুন কিছু আবিষ্কারে। সে বরাবরই রহস্যের অনুরাগী, আর মিশেলের শান্ত স্বভাব তার এই অনুসন্ধিৎসু মনকে আরও উসকে দিত। পথ চলতে চলতে লিয়াম হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো। তার চোখ গিয়ে পড়ল পাথরের খাঁজে আটকে থাকা একটি জীর্ণ কাগজের টুকরোর ওপর। কাগজটি এতটাই পুরনো যে মনে হচ্ছিল শত শত বছর ধরে এটি সেখানেই পড়ে আছে। "মিশেল, এটা দেখো তো!" লিয়াম উত্তেজিত স্বরে বলল।
মিশেল কাছে এসে কাগজটি হাতে নিল। এটি সাধারণ কোনো কাগজ ছিল না। এর উপরিভাগে কিছু অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা ছিল, যা কোনো পরিচিত ভাষার অক্ষরের মতো দেখাচ্ছিল না। কাগজটা হাতে নিতেই যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত মিশেলের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। প্রতীকগুলো দেখতে প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকের মতো লাগছিল, কিন্তু সে বিষয়ে মিশেল নিশ্চিত ছিল না। "এগুলো কী?" মিশেল ফিসফিস করে বলল। "মনে হচ্ছে কোনো প্রাচীন ভাষা।"
লিয়াম দ্রুত তার ব্যাকপ্যাক থেকে একটি ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে নিল। "হুম, আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এর অর্থ কী হতে পারে?" তাদের কৌতূহল বাড়তে লাগল। ক্লিফের হিমেল বাতাস যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। তারা চিরকুটটি সাবধানে ভাজ করে নিল। বাতিঘরের দিকে যাওয়া তখন গৌণ হয়ে পড়ল। তাদের মনে তখন একটাই চিন্তা – এই রহস্যময় চিরকুটের অর্থ কী? আর কে বা কারা এটি এখানে ফেলে গেছে? লিয়াম সিদ্ধান্ত নিল, এই চিরকুটের রহস্য ভেদ করতেই হবে। তাদের পরবর্তী গন্তব্য ঠিক হলো ডাবলিন, যেখানে এই প্রাচীন ভাষার বিশেষজ্ঞদের খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তাদের রোমাঞ্চকর যাত্রা কেবল শুরু হলো।
চিরকুট হাতে নিয়ে মিশেল আর লিয়াম যখন ডাবলিনের দিকে রওনা হলো, তখন তাদের মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা। বাতিঘরের সূর্যাস্ত দেখার পরিকল্পনা তখন তাদের মন থেকে মুছে গেছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য এই প্রাচীন রহস্যের সমাধান করা। ডাবলিনে পৌঁছে তারা প্রথমেই গেল ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের লাইব্রেরিতে। তাদের ধারণা ছিল, যদি কেউ এই ভাষার অর্থ উদ্ধার করতে পারে, তবে সে অবশ্যই এখানে থাকবে।
লাইব্রেরির বিশাল করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা এক প্রবীণ ভাষাবিদ, প্রফেসর ডেরেক ও'কনেল-এর খোঁজ পেল। প্রফেসর ও'কনেল প্রাচীন ভাষা ও সভ্যতার একজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মিশেল ও লিয়াম তাদের সাথে দেখা করার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিল।
প্রফেসর ও'কনেলের অফিস ছিল বই আর প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে ভর্তি। একটি ধূলিধূসরিত চেয়ারে বসে প্রফেসর তাদের দিকে তাকালেন। লিয়াম সাবধানে চিরকুটটি তার হাতে তুলে দিল। প্রফেসর ও'কনেল ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কাগজটি পরীক্ষা করতে লাগলেন। তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। তিনি কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রতীকগুলো দেখলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, "এগুলো প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকের মতো দেখাচ্ছে, কিন্তু এর মধ্যে কিছু প্রতীক আছে যা সাধারণ নয়। এটি সম্ভবত কোনো বিশেষ বা গুপ্ত লিপি।"
মিশেল আর লিয়াম একে অপরের দিকে তাকালো। তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণিত হলো। প্রফেসর ও'কনেল ব্যাখ্যা করলেন, এই ধরনের লিপি প্রায়শই প্রাচীন কবর বা মন্দিরের গোপন স্থানে ব্যবহৃত হত। এর অর্থ উদ্ধার করা বেশ কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তিনি তাদের আশ্বাস দিলেন যে, তিনি এটি নিয়ে কাজ করবেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সাথে যোগাযোগ করবেন।
পরের কয়েকটা দিন মিশেল আর লিয়ামের জন্য ছিল উৎকণ্ঠার। তারা ডাবলিনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ালেও তাদের মনে ছিল শুধুই সেই চিরকুট আর তার রহস্য। অবশেষে, এক সপ্তাহ পর প্রফেসর ও'কনেলের ফোন এল। তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা স্পষ্ট। তিনি জানালেন, তিনি চিরকুটের অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছেন!
প্রফেসরের অফিসে পৌঁছানোর পর তিনি তাদের সামনে একটি মানচিত্র মেলে ধরলেন। মানচিত্রে মিশরের একটি নির্দিষ্ট স্থানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল – লুক্সরের "ভ্যালি অফ দ্য কিংস" (Valley of the Kings)। চিরকুটে লেখা ছিল একটি কবরের নাম এবং নম্বর: "থমোসিসের কবর, কক্ষ ৩৯" (Tomb of Thutmose, Chamber 39)। প্রফেসর ও'কনেল জানালেন, চিরকুটে কিছু সতর্কবার্তাও লেখা ছিল, যা কবরটিকে বিরক্ত না করার নির্দেশ দিচ্ছিল। কিন্তু মিশেল আর লিয়ামের মনে তখন নতুন এক অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি। তারা জানত, তাদের পরবর্তী গন্তব্য মিশর। তারা কি এই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে কবরের রহস্য উন্মোচন করতে পারবে?
প্রফেসর ও'কনেলের কাছ থেকে চিরকুটের সম্পূর্ণ অর্থ জানার পর মিশেল আর লিয়ামের রক্তে যেন অ্যাড্রেনালিন বইতে শুরু করল। "থমোসিসের কবর, কক্ষ ৩৯" - এই শব্দগুলো তাদের কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সতর্কবার্তা তাদের কৌতূহলকে আরও বাড়িয়ে দিল। তারা জানত, এই অভিযান বিপজ্জনক হতে পারে, কিন্তু রহস্যের টানে তারা কোনো বাধাকেই পরোয়া করছিল না। দ্রুত তারা মিশরের বিমান টিকিট কেটে ফেলল। আয়ারল্যান্ডের সবুজ প্রান্তর ছেড়ে তারা পাড়ি জমাল উষ্ণ মরুভূমির দেশে।
কায়রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর মিশেল আর লিয়াম যেন এক নতুন জগতে এসে পড়ল। ধুলোমাখা রাস্তা, গাড়ির হর্ন আর মানুষের কোলাহল তাদের স্বাগত জানাল। পিরামিড আর প্রাচীন মন্দিরের ছবি এতদিন বইয়ের পাতায় দেখে এলেও, এবার তারা সেগুলোর খুব কাছাকাছি। তারা কায়রো থেকে লুক্সরের উদ্দেশ্যে একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে গেল। লুক্সর ছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যেখানে ফারাওদের উপত্যকা - ভ্যালি অফ দ্য কিংস অবস্থিত।
লুক্সরে পৌঁছে তারা একটি ছোট হোটেলে উঠল। পরের দিন সকালেই তারা ভ্যালি অফ দ্য কিংসের দিকে রওনা হলো। বিস্তৃত মরুভূমির বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য প্রাচীন কবর, প্রতিটিই যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। সূর্য তখন মাথার ওপর গনগন করছে, আর বালি থেকে তাপের ঢেউ উঠছিল। গাইডের সাথে তারা ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে এগোতে লাগল।
ভ্যালি অফ দ্য কিংসের প্রবেশপথের কাছে এসে মিশেল আর লিয়ামের উত্তেজনা চরমে উঠল। তারা প্রফেসর ও'কনেলের দেওয়া মানচিত্রটি মিলিয়ে দেখছিল। থমোসিসের কবরের কথা খুব বেশি পরিচিত ছিল না, কারণ এটি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং কম বিখ্যাত কবরগুলোর মধ্যে একটি। গাইডের সাহায্যে তারা শেষ পর্যন্ত কক্ষ ৩৯-এর সামনে এসে দাঁড়াল। প্রবেশপথটি পাথরের চাঁই দিয়ে আংশিকভাবে ঢাকা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি বহুদিন ধরে খোলা হয়নি।
মিশেল লিয়ামের দিকে তাকাল। লিয়ামের চোখে তখন স্পষ্টতই এক রোমাঞ্চকর অভিযানের ঝলক। তারা প্রস্তুত ছিল, ভেতরের রহস্য উন্মোচন করতে। কিন্তু তারা কি জানত, এই কবরের গভীরে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে? প্রাচীন ফারাওয়ের ঘুম ভাঙিয়ে তারা কি কোনো অভিশাপকে ডেকে আনছে? তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে মিশরের প্রাচীন রহস্যের নিশ্বাস যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছিল।
কক্ষ ৩৯-এর প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে মিশেল আর লিয়াম একে অপরের দিকে তাকালো। সূর্যের আলোয় প্রবেশপথের পাথরে খোদাই করা অস্পষ্ট হায়ারোগ্লিফিকগুলো যেন আরও রহস্যময় দেখাচ্ছিল। তাদের মনে একইসাথে উত্তেজনা আর এক অজানা ভয় কাজ করছিল। গাইড তাদের বোঝানোর চেষ্টা করল যে এই ধরনের ছোট কবর সাধারণত বন্ধই রাখা হয়, কিন্তু মিশেল আর লিয়াম তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। তারা জানে যে, এই কবরের মধ্যে এমন কিছু আছে যা অন্য কোথাও নেই।
লিয়াম তার ব্যাগ থেকে একটি টর্চলাইট বের করল। বহু কষ্টে পাথরের চাঁই সরিয়ে তারা সরু প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢোকা মাত্রই এক অদ্ভুত, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাদের নাকে এসে লাগল। বাতাস যেন স্থির হয়ে ছিল বহু বছর ধরে। টর্চের আলোয় দেখা গেল দীর্ঘ একটি পাথরের করিডোর, যার দেয়াল জুড়ে আঁকা প্রাচীন মিশরীয় দেব-দেবী আর ফারাওদের জীবনের চিত্র। প্রতিটি চিত্র যেন কোনো গোপন বার্তা বহন করছিল। মিশেলের মনে হলো, এই দেয়ালগুলো যেন সহস্র বছরের নীরবতা নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তারা করিডোর ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। প্রতি পদক্ষেপে বালির নিচে চাপাপড়া শুকনো পাতার মচমচ শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ ছিল না। হঠাৎই করিডোরের শেষ প্রান্তে একটি বড় চেম্বার দেখা গেল। চেম্বারটি অপেক্ষাকৃত অন্ধকার ছিল, কারণ সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছাচ্ছিল না। টর্চের আলো ফেলতেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
চেম্বারের ঠিক মাঝখানে একটি প্রাচীন পাথরের সারকোফ্যাগাস (পাথরের কফিন) রাখা।
সারকোফ্যাগাসের ঢাকনার ওপর অসংখ্য হায়ারোগ্লিফিক খোদাই করা। এর চারপাশে কিছু ভাঙা মৃৎপাত্র আর কিছু জীর্ণ প্রাচীন আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল বহু বছর আগে কেউ এখানে প্রবেশ করেনি। মিশেলের বুক ধড়ফড় করে উঠল। চিরকুটে উল্লেখিত "থমোসিসের কবর" যে এটাই, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।
লিয়াম সাবধানে সারকোফ্যাগাসের কাছে গেল। তার হাত কাঁপছিল। সে ধীরে ধীরে ঢাকনার ওপর হাত রাখল। ঢাকনাটি ছিল অবিশ্বাস্যরকম ভারী, কিন্তু লিয়াম তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করল। একসময় এক কর্কশ শব্দ করে ঢাকনাটি সামান্য সরে গেল। ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই তারা যা দেখল, তাতে তাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
সারকোফ্যাগাসের ভেতরে একটি মমি রাখা। মমিটি অত্যন্ত যত্ন সহকারে লিনেন ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মমির বুকের উপর একটি প্রাচীন তাবিজে খোদাই করা ছিল কিছু অদ্ভুত প্রতীক। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল মমির মুখের অভিব্যক্তি। চোখগুলো ছিল কোটরাগত, আর মুখটি এমনভাবে খোলা ছিল যেন মৃত্যুর পূর্বে কোনো চরম যন্ত্রণায় সে চিৎকার করেছিল। মমিটি দেখে মনে হলো যেন এটি ঘুমিয়ে নেই, বরং যেকোনো মুহূর্তে উঠে দাঁড়াতে পারে। মিশেলের মনে হলো, বাতাসের চাপ হঠাৎই কমে গেছে, যেন এই কক্ষের প্রতিটি অণু তাদের উপস্থিতি অনুভব করছে। তারা কি ফারাওয়ের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে? এই মমি কি সত্যিই থমোসিসের, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও ভয়ঙ্কর কোনো সত্য? তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, প্রফেসর ও'কনেলের সতর্কবার্তার প্রকৃত অর্থ কি এই মমিই?
মমিটির ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে মিশেল আর লিয়াম পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মমির কোটরাগত চোখ যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, আর খোলা মুখটা থেকে যেন এক অব্যক্ত চিৎকারের শব্দ বেরোচ্ছিল। লিয়ামের হাত থেকে টর্চলাইটটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। মিশেল নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে চারপাশের দেয়ালগুলোর দিকে টটর্চের আলো ফেলল। এতদিন যেসব হায়ারোগ্লিফিক শুধু প্রাচীন চিত্র বলে মনে হচ্ছিল, এখন সেগুলোর মধ্যে যেন এক নতুন অর্থ ধরা পড়ল। দেয়ালে আঁকা ছিল একটি অভিশাপের বর্ণনা – যারা এই কবরের শান্তি ভঙ্গ করবে, তাদের ওপর নেমে আসবে এক ভয়ংকর প্রতিশোধ।
হঠাৎ চেম্বারের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে শুরু করল। বাতাসের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুরণন শোনা গেল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের চারপাশে ঘুরছে। মমির লিনেন ব্যান্ডেজগুলো যেন মৃদু কাঁপতে শুরু করল। মিশেল লিয়ামের হাত শক্ত করে ধরল। তাদের বুক ধড়ফড় করছিল। তারা বুঝতে পারছিল, প্রফেসর ও'কনেলের সতর্কবার্তা শুধু কাগজের অক্ষর ছিল না, এটি ছিল একটি বাস্তব হুমকি।
হঠাৎই, সারকোফ্যাগাসের মধ্য থেকে একটি চাপা গোঙানির শব্দ শোনা গেল। মমিটির চোখগুলো যেন মুহূর্তের জন্য জীবন্ত হয়ে উঠল, তাতে লালচে আভা খেলে গেল। মিশেল আর লিয়াম ভয়ে চিৎকার করে উঠল এবং পেছনে সরে গেল। মমির হাতগুলো ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করল, যেন সেটি কফিনের ভেতর থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। কক্ষের ভেতরে থাকা প্রাচীন আসবাবপত্রগুলো হঠাৎ করেই নড়ে উঠল, আর কিছু মৃৎপাত্র ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বাতাসের সেই অনুরণন এখন এক ভয়ংকর চিৎকারে পরিণত হয়েছে।
লিয়াম আর মিশেল বুঝতে পারল তাদের দ্রুত এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
তারা যে এমন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, তা তারা কল্পনাও করেনি। তারা যত দ্রুত সম্ভব প্রবেশপথের দিকে ছুটল। পেছনে তখনো শোনা যাচ্ছিল সেই গোঙানির শব্দ, যা ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। করিডোর দিয়ে পালানোর সময় তাদের মনে হচ্ছিল যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের অনুসরণ করছে। ঠান্ডা বাতাস তাদের গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের ধরতে চাইছে।
তারা কোনোমতে সেই পাথরের চাঁই সরিয়ে কবরের বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরের মরুভূমির উষ্ণ বাতাস তাদের শরীরে লাগতেই তারা যেন আবার জীবন ফিরে পেল। সূর্যের আলোয় তারা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখে তখনো ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তারা দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল, পেছনে ফিরে একবারও তাকানোর সাহস পেল না।
মিশেল আর লিয়াম মিশর ছেড়ে নিজেদের দেশে ফিরে এলেও, কক্ষ ৩৯-এর সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা তাদের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে রইল। রাতের পর রাত তারা দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল, যেখানে সেই মমি তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে আসছিল। চিরকুটের অভিশাপ তাদের পিছু ছাড়ল না। তারা জেনেছিল, কিছু রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করা উচিত নয়। কিছু প্রাচীন ঘুমন্ত অভিশাপকে তাদের স্থানেই থাকতে দেওয়া উচিত। থমোসিসের মমি তাদের শিখিয়েছিল, কিছু সত্য কবরস্তই থাকুক। এই ঘটনা তাদের জীবনে
এক নতুন মোড় আনল, এবং তারা আর কখনো রহস্যের পেছনে ছোটাছুটি করল না।
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder