এলসের রহস্য
- অভিজিৎ হালদার •••
জার্মানির হার্জ পর্বতমালার কোল ঘেঁষে, ব্রাউনল্যাজ শহরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে 'গ্রাউফেল্ড স্কুল' — যার প্রতিটি ইটে মিশে আছে শতবর্ষের ইতিহাস। একসময় যেখানে শিশুদের কলরবে মুখরিত থাকত প্রাঙ্গণ, আজ সেখানে কেবলই এক চাপা রহস্য আর দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। স্থানীয় লোকমুখে ফেরে এর অন্ধকার করিডোর আর জীর্ণ শ্রেণীকক্ষের গল্প, যেখানে প্রায়ই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকে বলে, রাতের বেলায় নাকি জানলার কাঁচের ওপারে আবছা ছায়া দেখা যায়, আর ফিসফিস করে কারা যেন কথা বলে। এসব গল্প শুনে ছোট্ট লেনা (Lena) মাঝে মাঝে শিউরে উঠত, যদিও সে নিজেও এই স্কুলেরই একজন ছাত্রী ছিল।
লেনা ও তার মা মারি (Marie)-র সাথে ব্রাউনল্যাজ-এর সাপ্তাহিক বাজারে গিয়েছিল। সেদিন ছিল ছুটির দিন, তাই বাজার ছিল লোকে লোকারণ্য। মারি যখন তাজা সবজি বেছে নিচ্ছিলেন, লেনা তখন অন্য পথ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে খেলনার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।
খেলনার দোকানে সারি সারি পুতুলের ভিড়ে লেনার চোখ আটকে গেল একটি পুরনো, ফ্যাকাশেমুখী পুতুলের দিকে। পুতুলটির চোখ দুটি ছিল কাঁচের, কিন্তু সেগুলোতে যেন এক অদ্ভুত জীবন ছিল। লেনা পুতুলটিকে কোলে তুলে নিতেই কেমন যেন এক শীতল অনুভূতি হল। পুতুলটির নাম ছিল 'এলসে' (Else)। পুতুলের পোশাক ছিল পুরনো, অনেকটা শত বছর আগের জার্মান মেয়েদের মতো। লেনা তার মায়ের কাছে বায়না ধরল এলসেকে কেনার জন্য। মারি প্রথমে দ্বিধা করলেন। কারণ পুতুলটি বেশ পুরনো দেখাচ্ছিল, কিন্তু মেয়ের আবদারে শেষমেশ রাজি হলেন।
লেনা হাসিমুখে এলসেকে নিয়ে বাড়ি ফিরল, তার ছোট্ট মনে তখন কেবলই আনন্দ। সে জানত না, এই পুতুলের অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা আছে তার ভবিষ্যৎ, এক অজানা রহস্যের দ্বার খুলতে চলেছে তার জীবনে।
এলসে ঘরে আসার পর থেকে লেনার জীবনে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করল। স্কুলে লেনার দুষ্টু সহপাঠীরা যখন তাকে বিরক্ত করত, তখন অকারণে তাদের জিনিসপত্র উধাও হয়ে যেত, অথবা আচমকা কিছু একটা তাদের পায়ে লেগে যেত। একবার লেনা স্কুলের খেলার মাঠে পা পিছলে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু অদৃশ্য কোনো হাত যেন তাকে ধরে ফেলল। সে নিজেকে সামলে নিল এবং কোনো আঘাত লাগল না। এই ঘটনাগুলো লেনার কাছে কেবল কাকতালীয় মনে হয়েছিল, কিন্তু তার মা মারি ধীরে ধীরে বিষয়টি লক্ষ্য করতে শুরু করলেন।
একদিন স্কুল বাসে একদল ছেলে লেনার ব্যাগ ছিনিয়ে নিতে গেলে, হঠাৎ বাসের ব্রেক ফেল করে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ছেলেরা ছিটকে পড়ল, আর লেনা অক্ষত রইল। তার ব্যাগ অক্ষত অবস্থায় তার কোলেই ফিরে এল। লেনা লক্ষ্য করল, যখনই এমন কোনো ঘটনা ঘটে, তার এলসে পুতুলটা যেন একটু নড়ে ওঠে আর তার কাঁচের চোখে এক ঝলক আলো দেখা যায়। লেনা ছোটো হলেও বুঝতে পারছিল, এলসে শুধু একটা পুতুল নয়, সে যেন এক অদৃশ্য রক্ষাকর্ত্রী, যার উপস্থিতি লেনার জীবনে এক নতুন মাত্রা যোগ করছিল।
একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে লেনা এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হলো। সে গ্রামের একটি নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিল, হঠাৎ একটি দ্রুত গতির সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার দিকে ছুটে এল। লেনা আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল, নিশ্চিত ছিল যে এবার বড় ধরনের আঘাত পাবে। কিন্তু যখন সে চোখ খুলল, দেখল সাইকেলটি উল্টে পড়ে আছে আর তার চালক মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। লেনার শরীর যেন অদৃশ্য কোনো ঢাল দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। সে সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। এই ঘটনা লেনার মনে এক গভীর প্রশ্ন জাগালো – কে তাকে রক্ষা করছে?
বাড়িতে এসে লেনা তার এলসে পুতুলের দিকে তাকাল। পুতুলের কাঁচের চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি যেন খেলা করছিল। লেনা পুতুলটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। সে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল সেই অদৃশ্য শক্তিকে, যা তাকে বারবার রক্ষা করে চলেছে। লেনা জানত না, এই সুরক্ষা শুধু আজকের নয়, বরং বহু পুরনো এক গল্পের অংশ, যা হার্জ পর্বতের চূড়ায় লুকিয়ে আছে।
বছর গড়াতে লাগল। লেনা এখন এক প্রাণবন্ত কিশোরী। গ্রাউফেল্ড স্কুলের দিনগুলো তার কাছে ধূসর স্মৃতি। তার পাশে এলসে সবসময় থাকত, যদিও এখন সে তাকে ততটা নাড়াচাড়া করত না। এলসে এখন কেবল তার ঘরের তাকে নীরবে বসে থাকত, লেনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে। লেনা বুঝতে পারত না কেন, কিন্তু এলসেকে ছেড়ে থাকতে তার কষ্ট হতো। সে জানত না, এই পুতুলের মধ্যে এক গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, যা তাকে আগলে রাখছে, এবং তার জীবনের প্রতিটি ধাপে অদৃশ্যভাবে তাকে সুরক্ষা দিচ্ছে।
এলসে এখন আর সেই ছোটো পুতুলটি ছিল না, যে বিপদের সময় নড়ে উঠত। সে এখন লেনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার নীরবে থাকা সঙ্গী। লেনা প্রায়শই তার স্কুলের বন্ধুদের সাথে এলসের গল্প বলত, কিন্তু তারা কেবল হেসে উড়িয়ে দিত। তারা জানত না, এই পুতুলটির মধ্যে কী গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। লেনা জানত না, তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে, আর এলসে সেই পরিবর্তনেরও নীরব সাক্ষী থাকবে।
লেনার জীবনে এল লার্স (Lars)যে সুদর্শন, বুদ্ধিমান লার্সকে প্রথম দেখাতেই লেনার ভালো লেগে গিয়েছিল। তাদের পরিচয় একটি স্থানীয় শিল্প প্রদর্শনীতে হয়েছিল, যেখানে লেনা তার চিত্রকর্ম প্রদর্শন করছিল। লার্স লেনার শিল্পকর্মের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিল, এবং সেই মুগ্ধতা থেকেই তাদের সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল। তাদের সম্পর্ক দ্রুত গভীর হলো, ভালোবাসায় ভরে উঠল তাদের ভিতর দিনে দিনে। তারা একসঙ্গে হার্জ পর্বতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করত, পুরনো গল্প করত। লেনা লার্সের সাথে তার শৈশবের সব গল্প শেয়ার করত, কিন্তু এলসের বিষয়ে সে কিছুই বলত না। এলসে যেন তার একান্ত নিজস্ব এক গোপন রহস্য ছিল।
লার্স যখন প্রথম লেনার ঘরে এল, তার চোখ আটকে গেল এলসে পুতুলের দিকে। লেনার ঘরের তাকে বসা এলসের কাঁচের চোখ দুটো যেন লাসের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়েছিল। লার্স পুতুলটাকে হাতে তুলে নিতেই কেমন যেন এক চাপা অস্বস্তি কাজ করল তার মনে। সে পুতুলটাকে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর লেনার দিকে তাকিয়ে হাসল। লার্স হয়তো তখনো জানত না, এই পুতুলের সাথে তার জীবনেরও এক গভীর যোগসূত্র রয়েছে।
লেনা আর লার্সের ভালোবাসার সম্পর্ক এখন বিবাহের দিকে এগোচ্ছে। তাদের বিয়ের দিন ঠিক হলো। লেনা তার বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়ে লার্সের বাড়িতে যাবে। তার সব জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেল। প্রতিটি বাক্স যত্ন করে ভরা হচ্ছিল, নতুন জীবনের স্বপ্নের মতো। যখন এলসেকে একটি বাক্সে ভরা হচ্ছিল, লার্স বলল, "লেনা, এই পুতুলটা কি তোমার কাছে খুব প্রিয়? আমার মনে হচ্ছে, এর মধ্যে কিছু একটা আছে।" লার্স এলসের দিকে কেমন যেন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।
লেনা হেসে বলল, "এলসে আমার শৈশবের সঙ্গী, একটা পুরনো খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়।" লার্স আর কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখে এক গভীর চিন্তার ছাপ দেখা গেল। এলসের কাঁচের চোখ দুটো যেন লাসের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়েছিল, যেন কিছু বলতে চাইছে। এলসে এখন নীরব, কিন্তু তার উপস্থিতি লেনা আর লাসের জীবনে এক নতুন রহস্যের সৃষ্টি করছিল।
বিয়ের পর এলসে পুতুলটিও লার্সের বাড়িতে এল। লেনার নতুন ঘরের তাকে তাকে সম্মানের সঙ্গে রাখা হলো। লেনা মাঝে মাঝে এলসের দিকে তাকিয়ে তার শৈশবের কথা মনে করত। সে অবাক হয়ে যেত, কীভাবে এই পুতুলটি তার এত বছরের সঙ্গী হয়ে আছে। কিন্তু লার্সের আচরণে লেনা কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করল। লার্স মাঝে মাঝেই এলসের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, যেন সে পুতুলের মধ্যে কিছু একটা খুঁজছে।
এক রাতে লেনা দেখল, এলসে পুতুলটা লার্সের পড়ার টেবিলের উপর আপনা আপনি নড়ে উঠল। পরের দিন লেনা লার্সের সঙ্গে এলসেকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখল, লার্স কেমন যেন অস্বস্তিতে ভুগছে। সে বারবার কথা এড়িয়ে যাচ্ছিল। লার্স মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যেত। তার মুখে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ফুটে উঠত। লেনা বুঝতে পারছিল না, কী হচ্ছে। সে অনুভব করল, লার্সের এই অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে এলসে পুতুলের একটা রহস্যময় ভূমিকা আছে।
একদিন লার্স লেনার কাছে একটি পুরনো ছবি নিয়ে এল। ছবিটি প্রায় বিবর্ণ হয়ে গেছে, কিন্তু তার ভেতরের স্মৃতিগুলো জীবন্ত। ছবিতে দুজন ছোটো বাচ্চা, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, হার্জ পর্বতমালার উঁচু এক চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি অবিকল এলসের মতো দেখতে! তার পোশাক, তার মুখমণ্ডল, তার অভিব্যক্তি – যেন এলসেরই প্রতিচ্ছবি। লার্স খুব শান্ত গলায় বলতে শুরু করল, "এই মেয়েটি ছিল মার্গারেট (Margarete), আমার শৈশবের বান্ধবী। আমরা একসঙ্গে হার্জ পর্বতে ঘুরতে গিয়েছিলাম, যখন আমরা খুব ছোটো ছিলাম। সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে ও পাহাড় থেকে পিছলে পড়ে যায়। আমি ওর হাত ধরতে পারিনি, মার্গারেট গভীর খাদে পড়ে যায়। আমি তাকে হত্যা করিনি, কিন্তু আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি।" লার্সের চোখ ছলছল করছিল।
"যখন তুমি এলসেকে নিয়ে এলে, আমার মনে হল যেন মার্গারেট ফিরে এসেছে। ওর চোখ, ওর মুখ… যেন মার্গারেটই পুতুলের ভেতরে।" লার্স তখন লেনার হাত ধরে বলল, "আমি জানি, এলসের মধ্যে মার্গারেটের আত্মা আছে। সে তোমাকে রক্ষা করেছে কারণ তুমি হয়তো আমার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা। মার্গারেট, আমার প্রথম ভালোবাসা, হয়তো চায়নি আমার জীবনে কোনো ক্ষতি আসুক। সে আমার ভালোবাসার মানুষদের রক্ষা করতে চায়।" লেনার মনে পড়ল শৈশবের সমস্ত অলৌকিক ঘটনা। এলসের সুরক্ষা। তার চোখ জলে ভরে গেল।
লেনা নীরব রইল। লার্সের কথাগুলো তার মনে গেঁথে গেল। শৈশবের সেই অলৌকিক ঘটনাগুলো, এলসের অদৃশ্য সুরক্ষা, সবকিছু যেন এক মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল। এলসে পুতুলটা তখনও টেবিলের ওপর রাখা ছিল, তার কাঁচের চোখ দুটো যেন লেনা আর লার্সের দিকে এক মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মার্গারেটের আত্মা, ভালোবাসার অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা এক রক্ষা কবচ হয়ে রয়ে গেল তাদের জীবনে। লেনা আর লার্স জানত, তাদের ভালোবাসা কেবল দুজনের নয়, বরং মার্গারেটের আত্মা, তার ভালোবাসার অংশীদার হয়ে তাদের পাশে আছে।
মার্গারেটের আত্মা তাদের ভালোবাসাকে রক্ষা করছিল, ঠিক যেমন সে লেনার শৈশবে তাকে বিপদ থেকে আগলে রেখেছিল। তারা বুঝতে পারল, ভালোবাসা শুধু বেঁচে থাকাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আত্মাদের মধ্যেও সেতু তৈরি করতে পারে। লেনা আলতো করে এলসেকে স্পর্শ করল। তার মনে হল, এলসে যেন উষ্ণ হয়ে উঠেছে। লেনা ও লার্সের নতুন জীবন শুরু হলো, যেখানে ভালোবাসার এক অদৃশ্য অভিভাবক তাদের সবসময় রক্ষা করে চলেছিল। গ্রাউফেল্ড স্কুলের পুরনো দিনের রহস্য, আর হার্জ পর্বতের অ
জানা গল্পগুলো যেন এক নতুন অর্থ পেয়েছিল তাদের জীবনে।
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder