দ্য রেইনক্লিফ ম্যানশনের অভিশাপ
- অভিজিৎ হালদার •••
আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে, রুক্ষ এবং পাথুরে ক্লিফের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল রেইনক্লিফ ম্যানশন। শতাব্দী প্রাচীন এই বাড়িটি বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল, তার জানালাগুলো যেন অন্ধ চোখের মতো সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকত। স্থানীয়দের কাছে এটি ছিল এক অভিশপ্ত স্থান, যেখানে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো পৌঁছাতে ভয় পেত। এই ম্যানশনের একমাত্র বাসিন্দা ছিল একজন নির্জনতাপ্রিয় চিত্রশিল্পী, মি. এলিজা ক্রেন। শহর থেকে অনেক দূরে, প্রকৃতির কোলে নিজের শিল্পচর্চা নিয়ে তিনি মগ্ন থাকতেন। তার জীবন ছিল শান্ত এবং একঘেয়ে, যতক্ষণ না সেই ভয়াল রাত আসে।
সেটা ছিল এক শীতের রাত। আকাশ চিড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল আর সমুদ্রের গর্জন মিশে যাচ্ছিল বাতাসের গোঙানির সাথে। প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে রেইনক্লিফ ম্যানশনের দরজা ভেঙে পড়ার উপক্রম। হঠাৎই দরজায় তীব্র কড়া নাড়ার শব্দ এল। এলিজা দরজা খুলে দেখলেন, সামনে দাঁড়িয়ে এক অচেনা লোক, সম্পূর্ণ ভেজা, তার চোখে ভয়ের ছাপ। লোকটি কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তার শরীর কাঁপছিল থরথর করে। এলিজা তাকে ভিতরে আসতে দিলেন। আগন্তুক নিজেকে মি. ড্যামিয়েন থর্ন হিসেবে পরিচয় দিল। ড্যামিয়েন ছিল এক ব্যবসায়ী, যে পথ হারিয়ে এই নির্জন জায়গায় এসে পড়েছিল। এলিজা তাকে উষ্ণ পানীয় দিলেন এবং আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। কিন্তু ড্যামিয়েন তখনও কাঁপছিল, তার চোখ জানালার দিকে স্থির। কিছুক্ষণের মধ্যেই, কোনো কারণ ছাড়াই, ড্যামিয়েন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল এবং নিথর হয়ে গেল। এলিজা হতবাক হয়ে গেলেন।
ড্যামিয়েনের মৃত্যুর পর রেইনক্লিফ ম্যানশন যেন আরও নির্জন, আরও ভুতুড়ে হয়ে উঠল। এলিজা সেই রাত থেকেই অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে শুরু করলেন। রাতে চাপা গোঙানির শব্দ, দরজার অনবরত খোলার আওয়াজ, ঠান্ডা বাতাসের ঝলকানি – সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ড্যামিয়েনের আত্মা এই বাড়ির সঙ্গে মিশে গেছে। তার ভয়, সন্দেহ দ্রুতই বাস্তব রূপ নিল যখন তিনি ড্যামিয়েনের অদৃশ্য ছায়া বাড়ির আনাচে-কানাচে দেখতে পেলেন। একসময় এলিজা আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি রেইনক্লিফ ম্যানশন ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন, পিছনে ফেলে গেলেন এক অভিশপ্ত বাড়ি।
বহু বছর কেটে গেছে। রেইনক্লিফ ম্যানশনের চারপাশে আরও অনেক কুসংস্কার জন্ম নিয়েছে। কেউ আর সেই বাড়ির পাশ দিয়েও যেত না। কিন্তু সব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে ছিল মানুষের কৌতূহল। এই কৌতূহলই টেনে আনল এক তরুণ প্রেমিক যুগলকে – লিয়াম এবং সোফিয়া। তারা রোমাঞ্চ ভালোবাসত, আর রেইনক্লিফ ম্যানশনের গল্প তাদের তীব্রভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তারা ভেবেছিল, এই ম্যানশন তাদের ভালোবাসার এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। নিজেদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে তারা একদিন পৌঁছে গেল রেইনক্লিফ ম্যানশনের সামনে।
লিয়াম এবং সোফিয়া প্রথমে ম্যানশনের ভুতুড়ে পরিবেশ উপভোগ করছিল। তারা হেসে গল্প করছিল আর চারিদিকে ঘুরে দেখছিল। কিন্তু সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল। তাদের মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাদের অনুসরণ করছে, চাপা ফিসফিসানি কানে আসছিল। সোফিয়া আতঙ্কিত হয়ে লিয়ামের হাত শক্ত করে ধরল। তারা যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি থেকে বের হতে চাইল, কিন্তু তাদের পায়ে যেন অদৃশ্য শিকল বাঁধা ছিল। পরদিন সকালে, যখন স্থানীয়রা কৌতূহলবশত ম্যানশনের দিকে তাকিয়েছিল, তারা দেখল দরজা খোলা। ভেতরে প্রবেশ করে তারা শুধু দেখল, লিয়াম এবং সোফিয়ার ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র পড়ে আছে, কিন্তু তাদের কোনো চিহ্ন নেই। তারা দুজন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। রেইনক্লিফ ম্যানশনের অভিশাপ আরও একবার তার অস্তিত্ব প্রমাণ করল।
লিয়াম এবং সোফিয়ার অন্তর্ধানের পর রেইনক্লিফ ম্যানশনের ভয় আরও তীব্র হলো। এই ম্যানশন এখন যেন এক ব্ল্যাকহোল, যেখানে একবার প্রবেশ করলে কেউ আর ফিরে আসে না। অনেকে চেষ্টা করেছিল ম্যানশনের রহস্য উন্মোচন করতে, কিন্তু তাদের পরিণতি একই হয়েছে – হয় তাদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, অথবা তারা চিরতরে উধাও হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকেও কয়েকবার তদন্ত চালানো হয়েছিল, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। ম্যানশনটি যেন তার অভিশাপের গভীরতায় আরও ডুবে যাচ্ছিল।
আরও কয়েক বছর পর, অলিভার এবং ইসাবেলা নামে এক নবদম্পতি তাদের মধুচন্দ্রিমা কাটাতে আয়ারল্যান্ডে এল। তারা ছিল অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, আর রেইনক্লিফ ম্যানশনের গল্প তাদের রোমাঞ্চিত করেছিল। যদিও স্থানীয়রা তাদের বারবার সাবধান করেছিল, তারা কোনো বাধা মানল না। ইসাবেলা ছিল একজন ফটোগ্রাফার, আর সে এই ম্যানশনের রহস্যময় সৌন্দর্যকে তার ক্যামেরাবন্দী করতে চেয়েছিল। অলিভারও ইসাবেলার এই সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছিল। তারা জানত না, তাদের জন্য কী ভয়াল পরিণতি অপেক্ষা করছে।
রেইনক্লিফ ম্যানশনে প্রবেশ করতেই অলিভার এবং ইসাবেলা এক গা ছমছমে নিস্তব্ধতা অনুভব করল। চারদিকে ধুলো আর মাকড়সার জাল, পুরনো আসবাবপত্র যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তারা ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল। একটি বড় হলঘরে প্রবেশ করতেই ইসাবেলা চিৎকার করে উঠল। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল! তারা দেখল, কিছু কঙ্কাল অর্ধ-পোশাক পরিহিত, কিছু কঙ্কাল হাতে ধরা জিনিসপত্র থেকে চেনা যাচ্ছে। ইসাবেলার চোখ পড়ল একটি কঙ্কালের হাতের ব্রেসলেটের দিকে – সেটি ছিল সোফিয়ার ব্রেসলেট! তারা বুঝতে পারল, ম্যানশনের গল্পগুলো মিথ্যে ছিল না। এই কঙ্কালগুলো তাদেরই যারা এই অভিশপ্ত বাড়ির গ্রাসে হারিয়ে গেছে।
অলিভার এবং ইসাবেলা আতঙ্কিত হয়ে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দরজাগুলো যেন অদৃশ্যভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তখনই তাদের কানে এক গভীর, বেদনাদায়ক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, "এই অভিশাপ তখনই কাটবে যখন এই বাড়িতে কোনো দম্পতি সন্তান জন্ম দেবে, এবং সেই সন্তানকে এই বাড়ির সকলের আত্মার জন্য আহুতি দিতে হবে।" তারা হতবাক হয়ে গেল। এই কি সেই অভিশাপ মুক্তির একমাত্র উপায়? তারা একে অপরের দিকে তাকাল, তাদের চোখে ভয় আর এক অদেখা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
অলিভার এবং ইসাবেলা এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হলো। তারা জানত, তাদের জীবন এখন এক অদৃশ্য জালে আবদ্ধ। মুক্তির একমাত্র উপায় হলো সন্তান জন্ম দেওয়া এবং তাকে এই বাড়ির অভিশপ্ত আত্মাদের জন্য উৎসর্গ করা। তারা অনেক দিন ধরে এই ম্যানশনে বন্দী ছিল, আশা আর নিরাশার দোলাচলে দুলছিল। অবশেষে, তারা সিদ্ধান্ত নিল। ইসাবেলা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। তাদের হৃদয়ে কষ্ট আর ভালোবাসার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল। সেই ভয়াল রাতে, তারা তাদের সন্তানকে ম্যানশনের মাঝখানে রেখে দিল। মুহূর্তেই এক তীব্র আলোর ঝলকানি হলো, আর ম্যানশনের দেওয়াল থেকে অসংখ্য আত্মার আর্তনাদ ভেসে এল। পরদিন সকালে, অলিভার এবং ইসাবেলা দেখল, ম্যানশনটি যেন তার সকল অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। সূর্যের আলো আলোকিত করছে তার প্রতিটি কোণ। কিন্তু তাদের সন্তান? সে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
অলিভার এবং ইসাবেলার সন্তান হারানোর পর রেইনক্লিফ ম্যানশনে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল। সূর্যোদয়ের আলো বাড়ির প্রতিটি কোণে নতুন করে জীবন সঞ্চার করল। দেয়ালের পুরনো শ্যাওলা যেন অদৃশ্য হয়ে গেল, ভেঙে যাওয়া জানালাগুলো নতুন করে ঝলমল করতে লাগল। অলিভার আর ইসাবেলা বিধ্বস্ত ছিল, কিন্তু তাদের মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা সত্ত্বেও এক ধরনের মুক্তি অনুভব করছিল। তারা ম্যানশন ছেড়ে চলে গেল, কিন্তু রেইনক্লিফ ম্যানশনের অভিশাপের স্মৃতি তাদের মনে চিরকাল গেঁথে রইল। ম্যানশনটি এবার সত্যি সত্যিই নির্জন হয়ে গেল, তবে এবার তা অভিশাপের কারণে নয়, বরং এক ভয়ংকর ত্যাগের নিদর্শণ হিসেবে।
বহু বছর কেটে গেল। রেইনক্লিফ ম্যানশনের গল্পগুলো রূপকথায় পরিণত হল, মানুষ ধীরে ধীরে তার ভয়াবহ ইতিহাস ভুলে যেতে শুরু করল। আয়ারল্যান্ডের পর্যটন শিল্প বৃদ্ধি পাওয়ায়, রেইনক্লিফ ম্যানশনের সৌন্দর্য নতুন করে আবিষ্কার হল। একজন ধনী ডেভেলপার, মি. প্যাট্রিক ও'ব্রায়ান, ম্যানশনটি কিনে নিলেন পর্যটকদের জন্য একটি বিলাসবহুল হোটেল বানানোর উদ্দেশ্যে। তার উদ্দেশ্য ছিল ম্যানশনের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনা এবং এটিকে আয়ারল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করা। স্থানীয়রা তাকে সাবধান করেছিল, কিন্তু প্যাট্রিক সেসব কানে তোলেননি। তিনি মনে করতেন, এগুলো নিছকই কুসংস্কার।
প্যাট্রিক ও'ব্রায়ান ম্যানশনের সংস্কার কাজ শুরু করলেন। নির্মাণ কর্মীরা দিনে-দুপুরে কাজ করত, কিন্তু রাতের বেলা ম্যানশনের ভিতরে অদ্ভুত ফিসফিসানি আর আলোর ঝলকানি দেখতে পেত। কেউ কেউ দাবি করত, তারা শিশুদের হাসির শব্দ শুনেছে, আবার কেউ কেউ বলেছে, তারা অতীতের ছায়ামূর্তি দেখেছে। প্যাট্রিক এসব উড়িয়ে দিতেন, কিন্তু কর্মীদের মধ্যে এক চাপা ভয় কাজ করত। সংস্কার কাজ দ্রুত গতিতে চলছিল, ম্যানশনটি তার নতুন রূপ পাচ্ছিল, কিন্তু তার গভীরে যেন কিছু একটা এখনও লুকিয়ে ছিল।
রেইনক্লিফ ম্যানশন তার নতুন নামে, "দ্য রেইনক্লিফ হেরিটেজ হোটেল" হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। বিলাসবহুল কক্ষ, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আর পুরনো দিনের আকর্ষণ – সব মিলিয়ে হোটেলটি পর্যটকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পেল। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসতে শুরু করল। প্যাট্রিক ও'ব্রায়ান গর্বিত ছিলেন তার এই সাফল্যের জন্য। হোটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু হোটেলের পুরনো কর্মী, যারা ম্যানশনের ইতিহাস জানত, তারা এক অজানা আশঙ্কায় ভুগছিল।
হোটেল চালু হওয়ার কিছুদিন পরেই অতিথিরা অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুরু করল। রুমগুলোতে জিনিসপত্র নিজেরা নড়াচড়া করত, ঠান্ডা বাতাসের ঝলকানি দেখা যেত এমনকি দিনের বেলায়ও। কেউ কেউ মাঝরাতে তাদের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনত, কিন্তু দরজা খুললে কেউ থাকত না। একদল পর্যটক অভিযোগ করল, তারা রাতে শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনেছে, যা তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। প্যাট্রিক এসবকে "পুরনো বাড়ির স্বাভাবিক ঘটনা" বলে উড়িয়ে দিতেন, কিন্তু অতিথিদের মধ্যে গুজব ছড়াতে শুরু করল।
হোটেলের একজন কর্মচারী, আনা মারফি, যে স্থানীয় এবং ম্যানশনের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জানত, সে অনুভব করল যে কিছু একটা ঠিক নেই। সে রাতে ম্যানশনের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় অদ্ভুত শক্তি অনুভব করত। একদিন রাতে, সে একা ম্যানশনের পুরনো গ্রন্থাগারে কাজ করার সময় একটি পুরনো ডায়রি খুঁজে পেল। সেটি ছিল এলিজা ক্রেনের ডায়রি, যেখানে তিনি ড্যামিয়েনের মৃত্যু এবং ম্যানশনে আত্মার আনাগোনার কথা লিখেছিলেন। আনা জানতে পারল, অভিশাপটি আসলে সন্তানের আত্মাহুতিতে সম্পূর্ণভাবে দূর হয়নি, বরং তার একটি অংশ এখনও ম্যানশনে রয়ে গেছে।
ডায়রিতে এলিজা একটি গুপ্ত কক্ষের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে তিনি তার শেষ চিত্রকর্মটি রেখে গিয়েছিলেন। সেই চিত্রকর্মটিতে নাকি ম্যানশনের অভিশাপের মূল কারণ লুকিয়ে আছে। আনা গ্রন্থাগারের একটি পুরনো দেয়ালের পেছনে সেই গুপ্ত পথটি খুঁজে পেল। ভয়ে ভয়ে সে ভিতরে প্রবেশ করল। কক্ষটি ছিল অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। সেখানে একটি বড় চিত্রকর্ম ছিল, যেখানে ড্যামিয়েনের আত্মার মুখটি স্পষ্টভাবে আঁকা ছিল এবং তার চারপাশে অনেক অস্পষ্ট মুখ ছিল, যারা ম্যানশনে হারিয়ে গিয়েছিল।
চিত্রকর্মের নিচে এলিজা ক্রেন লিখেছিলেন, "অভিশাপ মুক্তির জন্য শুধু একটি আত্মাহুতি যথেষ্ট নয়, বরং নতুন প্রজন্মকে এই বাড়ির অতীতের সত্যকে গ্রহণ করতে হবে এবং হারানো আত্মাদের শান্তি দিতে হবে।" আনা বুঝতে পারল, অভিশাপটি সম্পূর্ণ কাটেনি, বরং এক নতুন রূপে ফিরে এসেছে। ম্যানশনের প্রতিটি ইট, প্রতিটি পাথরে যেন অতীত থেকে যাওয়া যন্ত্রণা মিশে ছিল। ম্যানশনটি শুধুমাত্র ভৌতিক নয়, বরং এক প্রকার আত্মিক যন্ত্রণা বহন করছিল।
আনা প্যাট্রিক ও'ব্রায়ানকে সব ঘটনা খুলে বলল, কিন্তু তিনি তাকে পাত্তা দিলেন না। তবে হোটেলের অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো বাড়তে থাকায়, প্যাট্রিক নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এক রাতে, হোটেলের একটি কক্ষে হঠাৎ করে আসবাবপত্র নড়তে শুরু করল এবং একটি অস্পষ্ট শিশুর মূর্তি দেখা গেল। আতঙ্কিত হয়ে প্যাট্রিক আনাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন। আনা তাকে বোঝাল যে, অভিশাপ পুরোপুরি কাটেনি, বরং তা নতুন করে জাগ্রত হয়েছে। এবার আর বলিদানে নয়, বরং হারানো আত্মাদের স্বীকৃতি এবং শান্তিতেই মুক্তি।
আনা এবং প্যাট্রিক সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তারা ম্যানশনের অতীতকে সম্মান জানাবেন। তারা হোটেলের একটি অংশকে "রেইনক্লিফ মেমোরিয়াল হল" হিসেবে ঘোষণা করলেন, যেখানে ম্যানশনে হারানো প্রতিটি মানুষের নাম এবং তাদের স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করা হলো। এলিজা ক্রেনের চিত্রকর্মটি সেখানে সযত্নে রাখা হলো। তারা নিয়মিতভাবে ছোট ছোট স্মরণ সভার আয়োজন করতে শুরু করল, যেখানে ম্যানশনের অতীত বাসিন্দাদের জন্য প্রার্থনা করা হতো। ধীরে ধীরে হোটেলের ভিতরের অস্থিরতা কমে এল, অদ্ভুত ঘটনাগুলো বন্ধ হয়ে গেল। রেইনক্লিফ ম্যানশন এখন শুধু একটি হোটেল নয়, বরং এটি একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা অতীতে হারানো আত্মাদের সম্মান জানায় এবং তাদের শান্তি দেয়।
ম্যানশনের আত্মারা মুক্তি পেয়েছে তাদের চিরকালের বন্দিদশা থেকে, আর তার বিনিময়ে নিয়েছে এক নিষ্পাপ প্রাণ। রেইনক্লিফ ম্যানশন এখন আর ভুতুড়ে নেই, কিন্তু তার ইতিহাস চিরকাল মনে করিয়ে দেবে এক ভয়াল অভিশাপ এবং
তার মুক্তির চরম মূল্য।
••••• সমাপ্ত •••••
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder