সেকেন্ড চান্স
সন্ধ্যা নামছে ছোট্ট শহর কালীগঞ্জে। আকাশে জ্বলে উঠেছে প্রথম তারা, আর রাস্তার মোড়ের পুরোনো চায়ের দোকানটা থেকে ভেসে আসছে ফুটন্ত দুধের গন্ধ। সেখানেই বসে আছে রাহুল। সামনে এক কাপ চা, হাতে একটি পুরোনো চিঠি—যেটা সে কোনোদিন পাঠাতে পারেনি।
চিঠিটির কাগজ হলুদ হয়ে গেছে, কিন্তু ভিতরের কথাগুলো ঠিকই টাটকা—
“মীরা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
এই পাঁচটা শব্দ তার জীবনকে বদলে দিতে পারত, যদি সে তখন বলতে পারত।
রাহুল আর মীরা—একই স্কুলে পড়ত, একসাথে বড় হয়েছে। দু’জনের চোখে ছিল স্বপ্নের আলো, কিন্তু সেই আলো ছুঁয়ে দেখার সাহস রাহুলের কখনোই ছিল না। বাড়ির দারিদ্র্য, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আর মীরার উজ্জ্বল প্রতিভা—সব মিলিয়ে রাহুলের মনে হতো, “আমি ওর মতো কারও পাশে দাঁড়ানোর মতো যোগ্য নই।”
এভাবেই সময় কেটে গেল। মীরা পড়তে চলে গেল শহরে আর রাহুল বাবার দোকানে হাত লাগাতে লাগল। জীবন ধীরে ধীরে রুটিন হয়ে গেল—নতুন কিছু নেই, পুরোনো স্বপ্নগুলোকে ভুলে যাওয়ার অভিনয়।
কিন্তু মানুষ কি সত্যিই ভুলতে পারে?
সেদিন দুপুরে হঠাৎ খবর এল যে অনেক বছর পর মীরা শহর থেকে ফিরে এসেছে—কাজের ছুটিতে, কিছুদিনের জন্য। খবরটা শুনে রাহুলের বুকের ভেতর হঠাৎ এক অদ্ভুত আলোড়ন উঠল। এতদিন পর আবার দেখা হলে কি বলবে? বলবে যে, সে সবসময় তাকে ভালোবেসেছে? নাকি বলবে—“তুমি কেমন আছো?”
ডাক বাংলোর সামনে দেখা হলো। মীরা আগের মতোই হাসে—নরম, উষ্ণ, মাটির গন্ধমাখা হাসি। কিন্তু চোখে যেন একটু ক্লান্তি, একটু দূরত্ব।
“রাহুল, কতদিন পর!” — মীরা বলল।
রাহুল কেবল মাথা নাড়ল, কারণ গলাটা শুকিয়ে গেছে।
তারা হাঁটতে লাগল পুরোনো মাঠের দিকে। যেই মাঠে একসময় দু’জন মিলে খুব দৌড়াতো, আকাশের দিকে তাকিয়ে গল্প করত। কিন্তু আজ সবকিছুই চুপচাপ।
“শুনেছি তুমি বেশ বড় অফিসে কাজ করো?” — রাহুল জিজ্ঞেস করল।
মীরা হালকা হাসল। “হ্যাঁ, করছি। কিন্তু… সুখ সবসময় কাজ আর চাকরির পেছনে থাকে না বুঝেছ?”
রাহুল বুঝতে পারল, সেই হাসির নিচে আছে কষ্টের ছায়া। সে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো, কিন্তু সাহস পেল না।
হঠাৎই মীরা বলল,
“রাহুল, তুমি জানো, জীবনে অনেক কিছুই আমরা ফেলে আসি—এ ভেবে যে, হয়তো সময় আছে, হয়তো সুযোগ আসবে। কিন্তু কখনো আবার সুযোগ ফিরেও আসে না।”
রাহুলের বুকটা কেঁপে উঠল। এই কথাগুলো যেন তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল।
সে ধীরে ধীরে পকেট থেকে সেই পুরোনো চিঠিটা বের করল।
“মীরা… এটা তোমার জন্য লেখা। অনেক বছর আগে।”
মীরা অবাক হয়ে কাগজটা নিল। কাঁপা হাতে খুলল। দু’জনেই চুপ। বাতাসে শুধু কাশফুলের হালকা দোল।
কয়েক মুহূর্ত পর মীরার চোখ ভিজে উঠল।
“তুমি কখনো পাঠালে না কেন?”
রাহুল শক্ত করে গাল টিপল। “ভাবতাম আমি তোমার মতো মানুষের যোগ্য নই।”
মীরা শান্ত চোখে তাকাল। “রাহুল, যোগ্যতা মানুষ বানায় নিজে। কিন্তু অনুভূতি? সেটা তো হঠাৎ জন্মায়, আর ঠিক ততটাই সহজে হারিয়ে যায়… যদি আমরা তাকে ধরে রাখতে না পারি।”
রাহুল মাথা নিচু করল। “আমি দেরি করে ফেলেছি, তাই না?”
মীরা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। দূরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। মাঠের ওপরে লম্বা ছায়া পড়ছে।
তারপর ধীরে ধীরে বলল—
“হয়তো না।”
রাহুল অবাক হয়ে মুখ তুলল।
মীরা বলল, “তোমাকে একটা কথা বলি? শহরে আমার কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। অনেক বছর চেষ্টা করেছি তাকে ধরে রাখতে। কিন্তু ও আমাকে কখনো সত্যিকারের ভালোবাসেনি। সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেছে… আর আমি বুঝেছি, কখনো কখনো জীবনে একটি সেকেন্ড চান্স থাকেই।”
রাহুলের হৃদপিণ্ড যেন হঠাৎ দ্রুত ধকধক করতে শুরু করল।
“তাহলে… ?” — সে থেমে গেল, বাক্যগুলো যেন বের হতে চাইছে, আবার ভয়ে ফিরে যাচ্ছে।
মীরা এগিয়ে এসে রাহুলের দিকে তাকাল।
“তুমি কি এখনো আমাকে ভালোবাসো?”
রাহুল হাসল—একটা ভাঙা, কিন্তু সত্যি হাসি।
“মীরা, আমি কখনোই ভালোবাসা থামাইনি। কেবল বলতে পারিনি।”
মীরা তার হাতটা ধরল।
“তাহলে এবার বলো। কারণ এইবার সুযোগটা আমি হারাতে চাই না।”
বাতাসে কাশফুলের গন্ধ। দূরে গ্রামের মন্দিরে ঘন্টা পড়ছে। সূর্য ডুবে গিয়ে আকাশে রঙ লাগাচ্ছে গোলাপি-কমলার শাড়ি।
রাহুল মৃদুস্বরে বলল—
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, মীরা।”
এইবার আর কোনো চিঠির দরকার পড়ল না।
মীরা চোখ বন্ধ করে সেই কথাটা শুনল—ধীরে, গভীরভাবে। তারপর বলল,
“চলো, আমরা এবার নতুন করে শুরু করি। দু’জন মিলে।"
রাহুল যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তার জীবন এতদিন যেন একটা জায়গায় থেমে ছিল। আজ হঠাৎ মনে হলো পৃথিবীটা আবার ঘুরতে শুরু করেছে।
হাঁটতে হাঁটতে মীরা বলল—
“তুমি জানো, আমি ভেবেছিলাম আমাদের গল্পটা শেষ। কিন্তু হয়তো গল্পগুলো কখনোই শেষ হয় না—যদি আমরা চাই নতুন করে লিখতে।”
রাহুল হাসল।
“তাহলে লিখি, মীরা। এবার আর লুকিয়ে নয়।”
দু’জনের হাত একসাথে। রাতের অন্ধকার নেমে এলো, কিন্তু তাদের ভিতরে যেন একটা নতুন আলো জন্মাল। সেই আলোতেই শুরু হলো তাদের সেকেন্ড চান্স—একটি গল্প, যেটা বহু বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ হলো না।
কারণ ভালোবাসা মাঝে মাঝে ফিরে আসে।
যাদের জন্য আসে, তাদেরই জীবনে ঘটে—
সেকেন্ড চান্স।
•••••>>>>> সমাপ্ত <<<<<•••••••

