গল্পের নাম:- ছেলেটির ছেঁড়া জুতোর স্বপ্ন
লেখক:- অভিজিৎ হালদার
পথের ধুলোয় খেলা করা সেই ছোট্ট ছেলেটার নাম ছিল আরকো। তার বয়স তখন মাত্র সাত। সারা গ্রামেই তার দৌড়ঝাঁপ, হাসি, আর চোখভরা স্বপ্নের আলোর জন্য সে পরিচিত ছিল। কিন্তু দারিদ্র্য সব স্বপ্নকে সহজে উড়তে দেয় না—আর আরকোর জীবনও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
একদিন স্কুলে যেতে যেতে তার নজর পড়ল পাশের দোকানে ঝোলানো চকচকে একজোড়া জুতোর দিকে। নীল-সাদা রঙ, মোটা তলা, আর সামনে ছোট্ট লাল দাগ—সেই জুতোর দিকে তাকিয়েই আরকোর মন ভরে গেল। সে ভাবল, “এই জুতোটা যদি আমার হতো!”
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই বাবাকে বলল,
— বাবা, আমারও ওরকম একটা জুতো চাই। সবাই তো নতুন জুতো পরে স্কুলে যায়। আমি গেলে সবাই হাসে।
বাবা কাজে ক্লান্ত, মুখে ধুলো, হাতের তালুতে কড়া জমে গেছে। তিনি ধীরে দুলতে থাকা কাঁসার লণ্ঠনের আলোয় ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। তার চোখে কষ্টের রেখা, কিন্তু ভালোবাসার আলোও ছিল।
— বাবা, এইবার না হলে…?
বাবা কিছু বললেন না। শুধু ঠোঁট কামড়ে হেসে বললেন,
— আরকো, এই মাসে যদি কাজটা একটু ভালো হয়, তাহলে কিনে দেব।
কিন্তু মাস গেল, বছর গেল—কাজ আর ভালো হল না। আরকো প্রতিদিন স্কুলে যেত পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে, যা মাঝে মাঝে তার পা কেটে দিত। কিন্তু সে কখনও জেদ করত না। শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল—
“একদিন আমি এমন জুতো বানাব, যাতে কোনো আরকো আর কষ্ট না পায়।”
সময় কেটে গেল। দারিদ্র্য আর অপমান তাকে দুর্বল করেনি, বরং শক্ত বানিয়েছে। বড় হতে হতে আরকো জুতোর কাজ শেখা শুরু করল। পুরনো জুতো মেরামত করা, কাটিং, সেলাই—সবকিছু সে শিখল গভীর মনোযোগে। রাতে পড়াশোনা করত, দিনে কাজ।
বাবা মারা যাওয়ার আগে একদিন বলেছিলেন,
— তুই থেমে যাস না বাবা, তোর স্বপ্ন একদিন দুনিয়াকে দেখাবে।
আরকো থামেনি।
বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম, ছোট্ট দোকান থেকে বড় শোরুম, সেখান থেকে নিজের ব্র্যান্ড তৈরির পথ—সবকিছুই অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো খুঁজে পাওয়ার মতো কঠিন ছিল।
কিন্তু একদিন…
দুনিয়া দেখল নতুন এক নাম—“ARKO STEPS”, দেশের অন্যতম বড়ো জুতা কোম্পানি। তার ডিজাইন আর আরাম পৃথিবীর বড় বড় বাজারে পৌঁছে গেল।
কোম্পানির উদ্বোধনের দিনে আরকো মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিল—
— আজ আমি যে মানুষ, তা আমার বাবার জন্য। যেদিন তিনি আমাকে জুতো কিনে দিতে পারেননি, সেই দিনই আমার জীবনের প্রথম জুতো তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল… আমার স্বপ্নের জুতো।
তার চোখ ভিজে গেল।
আর সেদিন থেকে ARKO STEPS-এর প্রথম নিয়মই হলো—
প্রতি ১০০ জুতো বিক্রি হলে একটি জুতো বিনামূল্যে দেওয়া হবে কোনো দরিদ্র বাচ্চাকে।
কেননা আরকো জানে—
একটি জুতো শুধু পা ঢাকে না, স্বপ্নও এগিয়ে নিয়ে যায়।

