প্রথম চুমুর জাদু
••• অভিজিৎ হালদাররাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। শহরের ভিড় একটু কমে এসেছে, রাস্তাগুলোতে আলো ঝলমল করছে। অর্ণবের চোখে আজ এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা। সে যেন ভেতরে ভেতরে অন্য এক পৃথিবীতে ভেসে যাচ্ছে। কারণ আজ সে প্রথমবার তার প্রেমিকা মেহরীনকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে। এতদিনের বুকের ভেতর জমে থাকা ভালোবাসার কথা বলবে।
অর্ণব জানে মেহরীন ভীষণ লাজুক। তারা দুজন একই কলেজে পড়ে, কিন্তু কখনো সরাসরি ভালোবাসার কথা বলেনি। শুধু চোখের ভাষায়, চিঠির মতো ছোট ছোট নোটে আর গানের ভেতর দিয়ে একে অপরকে বুঝিয়েছে। আজকের দিনটা ভিন্ন। সে ঠিক করেছে—আজ মেহরীনকে তার সবটুকু মনের কথা জানাবে।
মেহরীনের সাথে অর্ণবের পরিচয় হয়েছিল লাইব্রেরিতে। সে দিন বৃষ্টি হচ্ছিল, অর্ণবের হাতে ছাতাও ছিল না। ভিজে কাপড় নিয়ে লাইব্রেরির কোণে বসেছিল। হঠাৎই দেখেছিল মেহরীন তার পাশে বসে, ভিজে চুলগুলো কাঁধে লেগে আছে। সে চুপচাপ বই পড়ছিল, আর অর্ণব তাকিয়ে ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ করে। সেদিনই মনে মনে অর্ণব ভেবেছিল—“এই মেয়েটাই আমার পৃথিবী।”
তারপর থেকে তাদের গল্প শুরু হয়। বই বদল, গান শোনা, একসাথে ক্যান্টিনে বসা—সবকিছুতেই যেন নীরব ভালোবাসা জমতে লাগল।
একদিন রাতে অর্ণব ফোনে বলেছিল—
“মেহরীন, একটু ছাদে আসবে? তোমার জন্য একটা চমক আছে।”
মেহরীন প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। সে ভয় পেত, লোকজন কী বলবে। কিন্তু অর্ণবের গলায় আজ এক ধরনের আবেদন ছিল, তাই সে রাজি হয়ে গেল।
ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে অর্ণব আকাশের তারাগুলো দেখছিল। হঠাৎ পায়ের শব্দ শোনা গেল। মেহরীন আসছে। সাদা সালোয়ার, খোলা চুল, হালকা ঠান্ডা বাতাসে উড়ছে। অর্ণবের বুকের ভেতর ধকধক করতে লাগল।
মেহরীন হেসে বলল—
“কী চমক আছে বলো দেখি?”
অর্ণব তার দিকে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে বলল—
“চমক না, স্বপ্ন। তোমাকে বলতে চাইছিলাম এতদিন... তুমি কি জানো, তোমার চোখে আমি আমার পৃথিবী খুঁজে পাই?”
মেহরীন হঠাৎ চুপ করে গেল। বুকের ভেতর কিছু জমে উঠল। সে মুখ নামিয়ে ফেলল, কাঁধে খোলা চুল ঝরে পড়ল। অর্ণব এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরল।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, মেহরীন। এটাই সত্যি।”
মেহরীন ধীরে ধীরে মুখ তুলল। চোখে এক ফোঁটা জল। কিন্তু ঠোঁটে হালকা হাসি।
“তুমি এতদিনে বললে?”
অর্ণব উত্তর দিতে পারল না। সে শুধু মেহরীনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ মেহরীন খুব ধীরে এগিয়ে এল। অর্ণবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে কল্পনাও করেনি যে আজ এমন কিছু ঘটতে পারে।
মেহরীন দু’হাত দিয়ে অর্ণবের মুখ ধরল। তারপর এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে, ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল অর্ণবের ঠোঁটে।
সেই মুহূর্তে অর্ণব যেন সমস্ত পৃথিবী ভুলে গেল। তার ভেতর এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল। যেন সব গান, সব কবিতা, সব স্বপ্ন এসে মিলে গেল এই ছোট্ট চুমুর ভেতর।
চুমুটা ছিল দীর্ঘ নয়, কিন্তু এর মধ্যে ছিল হাজার বছরের ভালোবাসা, না বলা কথা, আর অনন্ত প্রতিশ্রুতি।
অর্ণব হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ভেবেছিল হয়তো তাকে একা ভালোবাসতে হবে, হয়তো মেহরীন শুধু বন্ধুই থাকবে। কিন্তু এই ছোট্ট চুমু তার সমস্ত ভয় মুছে দিল।
মেহরীন লজ্জায় মুখ নামিয়ে বলল—
“আমি তো অনেকদিন ধরে চাইছিলাম তুমি বলো... আমি ভয় পেতাম।”
অর্ণব হেসে উত্তর দিল—
“তাহলে আজ থেকে ভয়ের কিছু নেই। তুমি আর আমি—একসাথে।”
তারা দুজন একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। আকাশের তারা যেন ঝলমল করে উঠল আরও উজ্জ্বল হয়ে। সেই রাতে ছাদের ওপরে দুটি হৃদয় প্রথমবার সত্যি সত্যি এক হলো।
সেদিনের পর তাদের সম্পর্ক অন্য রকম হয়ে গেল। প্রতিটি দেখা, প্রতিটি ছোঁয়া, প্রতিটি হাসির মধ্যে ছিল নতুন উচ্ছ্বাস। প্রথম চুমুর জাদু তাদের জীবনে এমন এক আলো এনে দিল, যা সারাজীবন তাদের মনে থাকবে।
অর্ণব বুঝল, চুমু শুধু ঠোঁটের ছোঁয়া নয়—এটা প্রতিশ্রুতি, ভরসা আর ভালোবাসার এক নীরব ভাষা। আর মেহরীনের জন্য, সেটা ছিল নিজের সমস্ত ভয় ভেঙে প্রথমবার নিজেকে সমর্পণ করা।
অনেক বছর পরে, অর্ণব আর মেহরীন যখন বিয়ের পর একসাথে পুরনো ছবিগুলো দেখছিল, তখনো তারা সেই রাতের কথা মনে করে হাসল। মেহরীন ফিসফিস করে বলল—
“আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিল সেই প্রথম চুমু।”
অর্ণব হাত ধরে বলল—
“আমারও। কারণ ওই মুহূর্তেই আমি তোমাকে হারানোর সব ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম।”
তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল—ভালোবাসার শুরুটা হয়তো ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে, কিন্তু এর গভীরতা সারাজীবনের সমান।