••ব্লাক ফরেস্টের রহস্য ••
- অভিজিৎ হালদার
গ্লেনফিন্নানের শান্ত গ্রামটি যখন সূর্যোদয়ের সোনালী আলোয় ঝলমল করছিল, তখন গ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোক ইওনা ম্যাকলিয়ড এবং তার দুই বন্ধু অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ একটি দুঃসাহসিক অভিযানে বের হলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্লাকফরেস্টের গভীর জঙ্গলে লুকানো প্রাচীন ফেইরি পাথরটি খুঁজে বের করা। বছরের পর বছর ধরে শোনা যায় যে, এই পাথরের উপর একটি অভিশাপ রয়েছে, কিন্তু ইওনা বিশ্বাস করে যে এই অভিশাপের পেছনের রহস্য সে সমাধান করতে পারবে।
গ্রামের মোড়ে অ্যালেক্সের সাথে দেখা হলো ইওনার। অ্যালেক্স তার ব্যাগটি ঠিক করতে করতে বলল, "ইওনা, তুমি নিশ্চিত যে আমরা ব্লাকফরেস্টের গভীরে যাব? শুনেছি সেখানে অদ্ভুত সব জিনিস ঘটে।" ইওনা হেসে বলল, "ভয় পেও না, অ্যালেক্স। আমরা শুধু পাথরটা খুঁজে বের করে চলে আসব।" হ্যামিশ তাদের সাথে যোগ দিলো। তার হাতে ছিল একটি মানচিত্র, যা তার পূর্বপুরুষরা তৈরি করেছিল। "এই মানচিত্র অনুযায়ী, পাথরটি জঙ্গলের সবচেয়ে দুর্গম অংশে লুকিয়ে আছে," হ্যামিশ বলল।
তারা ব্লাকফরেস্টের দিকে এগিয়ে চলল। বনটি যতই ঘন হতে লাগলো, ততই চারপাশের পরিবেশ শীতল এবং রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগলো। বনের পুরনো গাছগুলো যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এমন একটা অনুভূতি হচ্ছিল। হঠাৎ ইওনা একটি অদ্ভুত গন্ধ পেল। গন্ধটা পচা মাংসের মতো। ইওনা তার বন্ধুদের বলল, "তোমরা কিছু গন্ধ পাচ্ছ?" অ্যালেক্স এবং হ্যামিশও গন্ধটা পেল এবং ভয়ে তাদের মুখ শুকিয়ে গেল। তারা সাবধানে গন্ধের উৎস খুঁজতে লাগলো। জঙ্গলের একটি নির্জন অংশের দিকে তারা এগিয়ে গেল। সেখানে একটি গাছের গুড়ির নিচে তারা কিছু দেখতে পেল। কাছে গিয়ে তারা দেখতে পেল যে সেখানে একটি মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। মৃতদেহটি এতটাই বিকৃত ছিল যে চেনার উপায় ছিল না। পোশাক দেখে মনে হলো এটি অনেক পুরনো।
ভয়ে তারা চমকে গেল। অ্যালেক্স বলল, "আমরা কি পুলিশকে খবর দেব?" ইওনা বলল, "হ্যাঁ, তবে আমাদের প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে।" তারা একটি ছবি তুলল এবং সেখান থেকে দ্রুত চলে গেল। গ্রামে ফিরে এসে তারা স্থানীয় পুলিশের কাছে মৃতদেহের খবর দিলো। পুলিশ এসে মৃতদেহটি উদ্ধার করল। কিন্তু ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা যা বলল, তা শুনে তারা অবাক হয়ে গেল। মৃতদেহটি নাকি শত শত বছরের পুরনো। কিন্তু ইওনা নিশ্চিত ছিল যে তার দেখা মৃতদেহটি এত পুরনো হতে পারে না। এ ঘটনার পর ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ আরও বেশি রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল। তারা বুঝতে পারল যে এই জঙ্গলে কিছু একটা লুকানো আছে, যা সাধারণ জ্ঞানের বাইরে। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা এই রহস্যের গভীরে যাবে এবং সত্য খুঁজে বের করবে। কিন্তু তারা জানত না যে তাদের জন্য আরও অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনা অপেক্ষা করছে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশকে আরও দ্বিধায় ফেলে দিল। মৃতদেহটি শত শত বছরের পুরনো, এই কথা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। ইওনা নিশ্চিত ছিল যে সে যখন মৃতদেহটি দেখেছিল, তখন তা তাজা ছিল। অ্যালেক্স এবং হ্যামিশও তার সাথে একমত ছিল। তারা বুঝতে পারছিল যে এই ঘটনার পিছনে কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।
পরদিন সকালে, ইওনা তার গবেষণাগারে বসেছিল। সে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, এবং তার জীবন কেটেছে পুরনো জিনিসের রহস্য উন্মোচন করতে। কিন্তু এই রহস্যটি তার সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেছে। হঠাৎ তার মনে হলো, যে মানচিত্রটি হ্যামিশের কাছে ছিল, তাতে হয়তো আরও কিছু তথ্য আছে। সে হ্যামিশকে ফোন করে বলল, "হ্যামিশ, তুমি কি তোমার মানচিত্রটা একবার ভালো করে দেখতে পারো? আমার মনে হয় সেখানে এমন কিছু লুকানো আছে, যা আমরা এখনো দেখিনি।"
হ্যামিশ মানচিত্রটি নিয়ে বসে পড়ল। সে প্রতিটি রেখা, প্রতিটি চিহ্ন মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। হঠাৎ সে দেখল যে মানচিত্রের একটি কোণে একটি ছোট প্রতীক আঁকা আছে, যা ব্লাকফরেস্টের ফেইরি পাথরের পাশে। প্রতীকটি দেখতে একটি পুরনো সেলটিক অক্ষরের মতো। হ্যামিশ ইওনাকে ফোন করে বলল, "ইওনা, আমি একটা অদ্ভুত প্রতীক খুঁজে পেয়েছি। এটা দেখতে একটা সেলটিক অক্ষরের মতো।"
ইওনা দ্রুত হ্যামিশের বাড়িতে চলে গেল। তারা দুজনে মিলে প্রতীকটি নিয়ে গবেষণা শুরু করল। তারা বুঝতে পারল যে প্রতীকটি একটি প্রাচীন গোত্রের প্রতীক, যারা শতাব্দী আগে স্কটল্যান্ডের এই অঞ্চলে বাস করত। এই গোত্রের লোকেরা জাদু এবং অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত। একই সময়, অ্যালেক্স পুলিশ প্রধান স্যার অ্যালিস্টেয়ার ডগলাসের কাছে গিয়েছিল। স্যার অ্যালিস্টেয়ার হ্যামিশের বাবা এবং তিনি একজন সৎ এবং কঠোর পুলিশ অফিসার। অ্যালেক্স তাকে তাদের দেখা মৃতদেহটি সম্পর্কে বলল এবং জানালো যে ফরেনসিক রিপোর্টটি ভুল হতে পারে। স্যার অ্যালিস্টেয়ার অ্যালেক্সের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, কিন্তু তিনি ফরেনসিক রিপোর্টকেই বিশ্বাস করলেন। তিনি অ্যালেক্সকে বললেন, "অ্যালেক্স, আমি জানি তোমরা কি দেখেছ, কিন্তু বিজ্ঞান বলছে অন্য কথা। আমি তোমাদেরকে অনুরোধ করছি, তোমরা এই রহস্য থেকে দূরে থাকো।"
স্যার অ্যালিস্টেয়ারের কথা অ্যালেক্সকে আরও হতাশ করে দিল। সে ইওনা এবং হ্যামিশের কাছে ফিরে গেল এবং তাদের সবকিছু বলল। ইওনা বুঝতে পারল যে পুলিশ এই রহস্যের গভীরে যেতে চায় না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা নিজেরাই এই রহস্যের সমাধান করবে। তারা আবারও ক্লাকফরেস্টের দিকে যাত্রা করার পরিকল্পনা করল, এবার আরও বেশি প্রস্তুতি নিয়ে। তারা মানচিত্রের প্রতীকটির অর্থ খুঁজে বের করবে এবং ফেইরি পাথরের রহস্য উন্মোচন করবে। কিন্তু তারা জানত না যে ক্লাকফরেস্টের অন্ধকার তাদের জন্য আরও ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে রেখেছে। এই যাত্রায় তাদের সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা তারা কল্পনাও করতে পারছিল না।
পুলিশ প্রধান স্যার অ্যালিস্টার তাদের সতর্ক করার পরও, ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ তাদের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেনি। তারা বিশ্বাস করত, এই রহস্যের সমাধান তাদের হাতেই। দ্বিতীয়বার ক্লাকফরেস্টে যাওয়ার জন্য তারা নিজেদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করল। এবার তাদের সাথে ছিল টর্চলাইট, খাবার এবং একটি কম্পাস। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হ্যামিশের প্রাচীন মানচিত্রটি, যা এখন তাদের কাছে কেবল একটি মানচিত্র নয়, বরং রহস্যের চাবিকাঠি।
তারা বনের গভীরে প্রবেশ করল। এবার বনটি আরও নীরব এবং ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল। পাখির কোনো ডাক শোনা যাচ্ছিল না, আর বাতাসের প্রতিটি ফিসফিস শব্দ যেন তাদের কানের কাছে কেউ কিছু বলার চেষ্টা করছে। ইওনা মানচিত্রটি ধরে হাঁটছিল। সে দেখছিল, ফেইরি পাথরের কাছে আঁকা সেলটিক প্রতীকটি ঠিক কোথায় নির্দেশ করছে। প্রতীকটি একটি ছোট গুহার মতো স্থানকে নির্দেশ করছিল, যা মানচিত্রে তেমন স্পষ্টভাবে আঁকা ছিল না।
অ্যালেক্স ফিসফিস করে বলল, "ইওনা, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা ভুল করছি। এখানে এমন কিছু আছে যা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বাইরে।" ইওনা তার দিকে তাকিয়ে বলল, "অ্যালেক্স, ভয় পেও না। আমরা একসাথে আছি। আমরা শুধু সত্যটা খুঁজে বের করতে চাই।"হ্যামিশ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। তার চোখ দুটি ছিল মানচিত্রের দিকে, আর তার হাতে ছিল একটি কম্পাস। "আমরা কাছাকাছি এসে গেছি। এই দিকে," সে একটি ঘন ঝোপের দিকে ইঙ্গিত করল। তারা ঝোপঝাড় ঠেলে একটি ছোট ফাঁকা জায়গায় পৌঁছাল। সেখানে একটি অদ্ভুত দৃশ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
ফাঁকা জায়গাটির মাঝখানে একটি বিশাল ওক গাছ দাঁড়িয়েছিল, আর তার নিচে পড়েছিল একটি মৃতদেহ। কিন্তু এটি সাধারণ কোনো মৃতদেহ ছিল না। তিন বন্ধু ভয়ে জমে গেল। মৃতদেহটি ঠিক সেইরকম ছিল যেমনটি তারা প্রথমবার দেখেছিল – একই ধরনের মলিন পোশাক, একইভাবে বিকৃত মুখ এবং পচনশীল দেহ। কিন্তু এবার তারা নিশ্চিত ছিল, এটি আগের জায়গা নয়। তারা যেখানে প্রথম মৃতদেহটি খুঁজে পেয়েছিল, এটি তার থেকে অনেক দূরে।
অ্যালেক্স চিৎকার করে বলল, "এ…এটা কি করে সম্ভব? আমরা তো নিশ্চিত ছিলাম যে পুলিশ সেই মৃতদেহটি নিয়ে গেছে!" ইওনা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার সব বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এই দৃশ্যের সামনে পরাজিত হয়েছিল। "এটা কি আমাদের চোখের ভ্রম? না, এটা একই মৃতদেহ। কিন্তু এটা এখানে কিভাবে এলো?"
হ্যামিশ আতঙ্কিত হয়ে বলল, "এটা আমাদের সাথে খেলা করছে। কেউ আমাদের সাথে খেলা করছে।" মৃতদেহটির পাশেই পড়েছিল একটি ছোট কাঠের বাক্স। বাক্সটি দেখতে খুবই পুরনো এবং তার উপরে সেই সেলটিক প্রতীকটি আঁকা ছিল, যা হ্যামিশ মানচিত্রে খুঁজে পেয়েছিল। ইওনা কম্পমান হাতে বাক্সটি তুলে নিল। বাক্সটি খুলে সে ভিতরে কিছু দেখতে পেল, যা তাদের এই রহস্যের গভীরে আরও টেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই আবিষ্কারের পর, তারা কি আর সাহস করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে? তাদের মনের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, কারণ তারা বুঝতে পারল যে এই রহস্যের সমাধান কেবল তাদের সাহস এবং বুদ্ধির উপর নির্ভর করে না, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে এমন কোনো শক্তি যা মানুষের ক্ষমতার বাইরে।
কাঠের বাক্সটি খুলে ইওনা তার ভেতরে একটি শক্ত কাগজের রোল দেখতে পেল। কাগজের রঙ হলুদ হয়ে গেছে, আর এর কিনারাগুলো শত বছরের পুরনো বলে ভঙ্গুর। ইওনা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কাগজটি তুলে নিলো। তার হাত কাঁপছিল, কারণ সে অনুভব করতে পারছিল যে এই সামান্য রোলটির মধ্যে ক্লাকফরেস্টের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে। কাগজটি খুলতেই তারা দেখল, এর উপর প্রাচীন সেলটিক ভাষার কিছু শব্দ এবং সেই একই অদ্ভুত প্রতীক আঁকা রয়েছে। ইওনা, তার প্রত্নতত্ত্বের জ্ঞান ব্যবহার করে, শব্দগুলো অনুবাদ করার চেষ্টা করল। অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ ইওনার চারপাশে ঝুঁকে পড়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছিল।
"এটা... এটা একটা গল্প," ইওনা ফিসফিস করে বলল। তার গলার স্বরে ছিল অবিশ্বাস এবং ভয় মেশানো। "এটা কোনো এক অ্যালিস্টার নামের মানুষের গল্প।"
হ্যামিশ প্রশ্ন করল, "অ্যালিস্টার? কে সে?"
ইওনা অনুবাদ চালিয়ে গেল, "অনেক শতাব্দী আগে, এই উপত্যকায় একটি প্রাচীন গোত্র বাস করত। তাদের প্রধান ছিল অ্যালিস্টার। সে এই ফেইরি পাথরের পবিত্রতার রক্ষক ছিল। কিন্তু লোভ তাকে গ্রাস করে। সে পাথরটির কিছু অলৌকিক শক্তি নিজের করে নিতে চেয়েছিল, যা ছিল গুরুতর এক পাপ।"
অ্যালেক্স ভয়ে বলল, "তাহলে কি হয়েছিল?"
ইওনা বলল, "পবিত্র পাথরটির অভিশাপ তার উপর পড়ে। অভিশাপ তাকে মৃত্যু দেয়, কিন্তু তার আত্মাকে এই বন থেকে মুক্তি দেয়নি। তার আত্মাকে তার পাপের জন্য চিরকাল এই বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে হবে এবং তার দেহ বারবার ফিরে আসবে, যেন অন্য কেউ আর এই লোভের ফাঁদে না পড়ে।"
অ্যালেক্স ভয়ে কাঁপছিল। "তাহলে...তাহলে যে মৃতদেহটা আমরা দেখছি, সেটা অ্যালিস্টারের? আর সেটাই বারবার ফিরে আসছে?"
ইওনা মাথা নাড়ল। "হ্যাঁ। এই কাগজটা তারই গল্প বলছে। কিন্তু... এর শেষটা আরও ভয়ঙ্কর।"
ইওনা যখন শেষ লাইনটি অনুবাদ করছিল, তখন চারপাশের নীরবতা যেন এক মুহূর্তের জন্য ভেঙে গেল। কাগজটিতে লেখা ছিল, "যে অভিশাপের রহস্য ভেদ করতে চাইবে, তার পরিণতিও হবে অ্যালিস্টারের মতো।"
ঠিক তখনই, চারপাশের বাতাস হঠাৎ শীতল হয়ে গেল। গাছের পাতাগুলো কোনো কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করল। তারা শুনতে পেল, বাতাসে ফিসফিস করে একটি অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, যেন কেউ অনেক দূর থেকে তাদের নাম ধরে ডাকছে। "ইওনা... অ্যালেক্স... হ্যামিশ..."
তারা বুঝতে পারছিল যে এই রহস্য শুধু একটি গল্প নয়, এটি একটি জীবন্ত অভিশাপ, যা তাদেরকেও গ্রাস করতে চাইছে। সেই মুহূর্ত থেকে, তাদের অভিযান কেবল সত্য খুঁজে বের করার জন্য নয়, বরং নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য। তারা সেই অভিশপ্ত ক্লাকফরেস্টে আটকে পড়েছে, আর একমাত্র পথ হচ্ছে হয় এই অভিশাপের সমাধান করা, নয়তো অ্যালিস্টারের মতোই অনন্তকাল ধরে এর শিকার হওয়া। এই নতুন ভয়ঙ্কর বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে, তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা তারা বুঝে উঠতে পারছিল না।
অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর যখন তাদের নাম ধরে ডাকছিল, তখন ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশের হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চারপাশের ঠান্ডা বাতাস যেন তাদের নিঃশ্বাস কেড়ে নিচ্ছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, তাদের চোখে ফুটে উঠেছিল গভীর আতঙ্ক। এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, এটা ছিল সেই অভিশাপের সরাসরি প্রতিফলন, যার কথা তারা মাত্রই জেনেছে। হঠাৎ অ্যালেক্স চিৎকার করে উঠল, "পালাও! এখান থেকে পালাও!" সে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ইওনা তার হাত চেপে ধরল। "অ্যালেক্স, শান্ত হও। আমরা জানি না এটা কী। আমরা..."
ইওনার কথা শেষ হলো না। তাদের সামনে পড়ে থাকা মৃতদেহটি হঠাৎ নড়ে উঠল। প্রথমে তার একটি আঙুল মৃদুভাবে কাঁপল, তারপর তার বিকৃত মাথাটি সামান্য হেলে গেল। চোখ দুটি, যা এতদিন ধরে নিষ্প্রাণ ছিল, সেই চোখ দুটি যেন তাদের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে বলে মনে হলো।
ভয়ে তাদের শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল। হ্যামিশ তার হাতের মানচিত্র ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল, "এটা জীবিত! এটা জীবিত হয়ে উঠছে!"
তাদের আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকার সাহস ছিল না। তারা দ্রুত সেই জায়গা থেকে দৌড়ে পালাল। ইওনা কোনোমতে কাঠের বাক্সটি এবং তার ভেতরের স্ক্রলটি হাতে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ তাকে অনুসরণ করল। তারা যে পথে এসেছিল, সেই পথে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ক্লাকফরেস্টের প্রতিটি গাছ যেন তাদের শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। গাছের শেকড়গুলো ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের চলার পথে বাধা দিচ্ছিল। গাছের ডালপালা তাদের পোশাক এবং শরীর আঁকড়ে ধরছিল। ঘন ঝোপঝাড় এমনভাবে তৈরি হয়েছিল যেন এটি একটি জীবন্ত প্রাচীর। তারা বুঝতে পারছিল যে বনটি তাদের বাইরে যেতে দিতে চাইছে না।
সেই ভৌতিক কণ্ঠস্বর তাদের পিছন পিছন আসছিল, এখন আরও স্পষ্ট এবং কঠোর হয়ে। "তোমরা অভিশাপের কথা জেনেছ, তাই তোমাদেরও এর শিকার হতে হবে। ক্লাকফরেস্টের অভিশাপ থেকে কোনো মুক্তি নেই... কোনো মুক্তি নেই!"
অ্যালেক্স চিৎকার করে বলল, "আমরা পথ হারিয়েছি! আমরা কোথায়?"
চারপাশটা এতটাই অন্ধকার ছিল যে তারা তাদের নিজেদের হাতও দেখতে পারছিল না। টর্চের আলোতে শুধু গাছের ছায়া এবং ঝোপের মধ্য দিয়ে অদ্ভুত সব আকৃতি দেখতে পাচ্ছিল। হঠাৎ তারা একটি ছোট খাদের সামনে এসে দাঁড়াল। এর গভীরতা অনেক ছিল এবং এর ওপারে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তারা বুঝতে পারল, তারা ফাঁদে পড়েছে।
তিনজন বন্ধু খাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। তাদের চারপাশ থেকে সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল, যা এখন হাসির শব্দে পরিণত হয়েছে। সেই হাসিতে কোনো আনন্দ ছিল না, ছিল কেবল চরম ঘৃণা এবং বিদ্বেষ। ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিজেদের অসহায়তা অনুভব করল। তারা জানত, এই অন্ধকার বন থেকে তাদের পালানোর কোনো পথ নেই, এবং অ্যালিস্টারের অভিশাপ তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।
গভীর খাদের সামনে দাঁড়িয়ে ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ বুঝতে পারছিল যে তারা এক ভয়ানক ফাঁদে আটকা পড়েছে। পিছন থেকে সেই অশুভ হাসির শব্দ তাদের পিছু ধাওয়া করছে, আর সামনে রয়েছে এক অনিশ্চিত অন্ধকার। অ্যালেক্স হতাশ হয়ে বলল, "আমাদের কোনো পথ নেই। আমরা এখানে শেষ হয়ে যাবো।"
কিন্তু ইওনা দমে গেল না। সে তার টর্চের আলো ফেলে খাদের চারপাশটা দেখতে লাগল। তার চোখ হঠাৎ একটা পাথরের উপর আটকে গেল, যেখানে মানচিত্রের সেই সেলটিক প্রতীকটি আঁকা ছিল। "এখানে কিছু একটা আছে!" সে বলল।
প্রতীকটি অনুসরণ করে তারা দেখল, খাদের কিনারা থেকে একটি সরু পাথরের রাস্তা নেমে গেছে, যা সাধারণ চোখে দেখা কঠিন। রাস্তাটি অপর প্রান্তের সাথে সংযুক্ত ছিল। মনে হলো এটি কোনো এক প্রাচীন সেতু, যা শত শত বছর ধরে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু সেতুটি ছিল নড়বড়ে এবং ভঙ্গুর, আর তার উপর পা রাখার সাহস করাও ছিল অসম্ভব।
হ্যামিশ বলল, "এটা পার হওয়া অসম্ভব। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।"
ইওনা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, "আর এখানে থাকলে আমরা নিশ্চিত মরে যাব। আমাদের আর কোনো উপায় নেই। আমাদের ঝুঁকি নিতেই হবে।"
অ্যালেক্স ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু তার দুই বন্ধুর দৃঢ়তা দেখে সেও সাহস পেল। তারা ধীরে ধীরে, সতর্কতার সাথে সেই পাথরের সেতু পার হতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে সেতুটি কাঁপছিল, আর পিছন থেকে সেই ভৌতিক হাসি আরও জোরালো হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন অভিশাপের শক্তিই তাদের চলার পথে বাধা দিচ্ছে।
কোনোরকমে তারা সেতুটি পার হয়ে অপর প্রান্তে পৌঁছাল। তারা নিরাপদ স্থানে পা রাখতেই বিকট এক শব্দে সেই সেতুটি ভেঙে পড়ল। ধুলো এবং পাথরের টুকরো খাদের গভীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারা এখন সত্যি সত্যিই ক্লাকফরেস্টের গভীরে আটকা পড়েছে, যেখান থেকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
নতুন এই জায়গাটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। গাছের ডালপালা এবং পরিবেশ যেন এক অদ্ভুত, জাদুকরী আলোয় আলোকিত ছিল। তাদের সামনে ছিল একটি ফাঁকা জায়গা, আর তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল এক বিশাল পাথর। এটিই সেই ফেইরি পাথর। পাথরটি কালো এবং মসৃণ, আর তার উপর থেকে একটি ফ্যাকাশে, মায়াবী আলো বেরোচ্ছিল। তার চারপাশে ঘুরছিল বাতাসের এক অশরীরী আবর্তন। তারা অনুভব করল, পাথরটির মধ্যে এক বিশাল এবং ক্ষতিকর শক্তি লুকিয়ে আছে।
ঠিক তখনই, পাথরটির পাশ থেকে একটি স্বচ্ছ, ছায়াময় আকৃতি বেরিয়ে এল। এটি একটি পুরুষের অবয়ব ছিল, কিন্তু তার মুখ ছিল বিকৃত এবং তার চোখ দুটি ক্রোধ ও যন্ত্রণায় ভরা। এটি ছিল অ্যালিস্টারের আত্মা। তার গায়ে ছিল সেই প্রাচীন পোশাক, যা তারা মৃতদেহের গায়ে দেখেছিল। তার মুখ থেকে সেই ভৌতিক কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল, "তোমরা এসেছ... যেমনটা লেখা ছিল... ক্লাকফরেস্টের অভিশাপের নতুন শিকাররা..."
অ্যালিস্টারের আত্মা তাদের দিকে তার কঙ্কালসার হাত বাড়িয়ে দিল। ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ বুঝতে পারল যে তাদের অভিযান এখন শেষ হয়েছে, এবং তাদের সামনে রয়েছে এক ভয়াবহ পরিণতি, যা থেকে তাদের কোনো পালানোর পথ নেই।
অ্যালিস্টারের স্বচ্ছ, ছায়াময় আকৃতি তাদের সামনে ভেসে উঠল। তার কণ্ঠস্বর ছিল শত শত বছরের নীরবতার ভারে ভারী, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার কথাগুলো পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছিল। তার চোখে ছিল এক গভীর যন্ত্রণা, যা তার ক্রোধের থেকেও বেশি শক্তিশালী ছিল।
"তোমরা কেন এসেছ?" অ্যালিস্টারের আত্মা প্রশ্ন করল, তার কণ্ঠে ছিল তিক্ততা। "তোমরা কি লোভের শিকার? নাকি কেবল কৌতুহলী? আমি যেমনটা ছিলাম, ঠিক তেমনটা।"
ইওনা ভয় কাটিয়ে উঠে বলল, "আমরা শুধু সত্যটা জানতে চেয়েছিলাম। আমরা আপনার অভিশাপের শিকার হতে চাই না।"
অ্যালিস্টারের আত্মা হতাশভাবে মাথা নাড়ল। "তোমাদের আর কোনো উপায় নেই। তোমরা যখন এই অভিশাপের কথা জেনেছ, তখন তোমরা এর অংশ হয়ে গেছো। আমিও ছিলাম ফেইরি পাথরের রক্ষক। আমার দায়িত্ব ছিল এই পাথরের পবিত্রতা রক্ষা করা। কিন্তু এর ভেতরের শক্তি আমাকে আকর্ষণ করেছিল। আমি সেই শক্তি নিজের করে নিতে চেয়েছিলাম, আর তার পরিণতি হিসেবে আমি এই বনের অভিশপ্ত কয়েদিতে পরিণত হয়েছি।"
অ্যালেক্স প্রশ্ন করল, "তাহলে কি এর থেকে কোনো মুক্তি নেই?"
অ্যালিস্টারের আত্মা বলল, "আছে। এই পাথরের অভিশাপকে শেষ করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতি এবং একটি বড় আত্মত্যাগ।" সে তার কঙ্কালসার হাত দিয়ে ইওনার হাতে থাকা সেই প্রাচীন স্ক্রলটির দিকে ইশারা করল। "এই স্ক্রলটিতেই অভিশাপ ভাঙার গোপন মন্ত্র লেখা আছে। কিন্তু এই মন্ত্র কেবল সঠিক সময়ে এবং সঠিক স্থানে উচ্চারণ করা সম্ভব।"
হ্যামিশ প্রশ্ন করল, "কোনো আত্মত্যাগ? কী ধরনের আত্মত্যাগ?"
অ্যালিস্টারের আত্মা বলল, "এই ফেইরি পাথরটি শক্তির উৎস। এটি নিজের শক্তি ফিরে পেতে চায়। যে অভিশাপ ভাঙার চেষ্টা করবে, তাকে সেই শক্তির একটি অংশ উৎসর্গ করতে হবে। আর সেই উৎসর্গ ছাড়া, অভিশাপ ভাঙা সম্ভব নয়।"
অ্যালিস্টারের আত্মা ধীরে ধীরে পাথরের দিকে ফিরে গেল। পাথরটির উপর একটি অদ্ভুত প্রতীক আঁকা ছিল, যা সেই স্ক্রলের একটি প্রতীকের সাথে মিলে যাচ্ছিল। অ্যালিস্টার বলল, "তোমাদের হাতে সময় কম। অভিশাপ তার নতুন শিকারকে খোঁজা শুরু করে দিয়েছে, এবং সেই শিকারেরা তোমরা।"
এই কথা বলার সাথে সাথে অ্যালিস্টারের আত্মা ফেইরি পাথরের মধ্যে মিলিয়ে গেল। পাথরটি আরও উজ্জ্বলভাবে জ্বলে উঠল, আর তার আলোতে দেখা গেল, বনের প্রতিটি গাছ যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের হাতে ছিল স্ক্রলটি এবং তাদের সামনে ছিল একটি ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত। হয় তারা অ্যালিস্টারের মতো চিরকাল এই অভিশাপের শিকার হবে, নয়তো তারা সেই ভয়ঙ্কর আত্মত্যাগের মাধ্যমে অভিশাপ ভাঙার চেষ্টা করবে। এই পথ থেকে ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না।
ফেইরি পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ বুঝতে পারছিল, তাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জ, তা কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিকও। পাথর থেকে নির্গত হওয়া এক অদ্ভুত শক্তি তাদের মনের গভীরে প্রবেশ করছিল। তাদের নিজেদের অস্তিত্ব যেন ধাপে ধাপে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল।
অ্যালেক্স ভয়ে ফিসফিস করে বলল, "আমি আর পারছি না। এই জায়গাটা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।"
ইওনা তার হাতে থাকা স্ক্রলটি মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। সে দেখল, স্ক্রলে শুধু মন্ত্র নয়, বরং সেই "আত্মত্যাগের" গোপন রহস্যটিও লেখা আছে। সে তার টর্চের আলো ফেলে সেই অংশটি অনুবাদ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার মনোযোগ বার বার ভেঙে যাচ্ছিল। কারণ, তার মনে হচ্ছিল, তার নিজের মনের মধ্যে থেকেই একটি কণ্ঠস্বর তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ অ্যালেক্স চিৎকার করে উঠল, "তোমরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছো! তোমরা আমাকে এই ফাঁদে ফেলেছ!"
হ্যামিশ হতবাক হয়ে বলল, "অ্যালেক্স, কী বলছ এসব? আমরা তোমার বন্ধু।"
কিন্তু অ্যালেক্স হ্যামিশের কথা শুনছিল না। তার চোখ দুটি উন্মাদনায় জ্বলছিল। "না! ওই পাথরটি আমাকে বলছে! বলছে যে তোমরা একজন... একজন শিকারকে খুঁজেছ। তোমরা আমাকে এই অভিশাপের নতুন শিকার বানাতে চাও!"
অ্যালেক্সের এই অপ্রত্যাশিত আচরণে ইওনা এবং হ্যামিশ হতবাক হয়ে গেল। অ্যালেক্সের মনে যে ভয় এবং সন্দেহ ছিল, অভিশাপের শক্তি তাকেই পুঁজি করে তাদের বন্ধুত্বকে ভেঙে দিতে চাইছে। অ্যালেক্স তাদের দিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো। হ্যামিশ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে, অ্যালেক্স তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
এই ভয়াবহ মুহূর্তে, ইওনা কোনোমতে স্ক্রলের সেই রহস্যময় অংশটি অনুবাদ করে ফেলল। তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে গেল। স্ক্রলে লেখা ছিল: "এই অভিশাপ ভাঙতে হলে, একটি সম্পূর্ণ জীবনের আলো... একটি পবিত্র আত্মা, তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই পাথরের শক্তিকে তৃপ্ত করবে।"
ইওনা চমকে গেল। "আত্মত্যাগ" মানে কোনো জিনিস নয়, বরং একজন মানুষের জীবন বা জীবনের একটি অংশ উৎসর্গ করা। এই পাথরকে শান্ত করতে হলে, তাদের তিনজনের মধ্যে একজনকেই এই আত্মত্যাগ করতে হবে।
অ্যালেক্স, উন্মত্ত অবস্থায়, ইওনার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, "এটা তুমিই! তোমার জ্ঞানই আমাদের এখানে এনেছে। তুমিই এই অভিশাপের যোগ্য শিকার!"
অ্যালেক্স যখন ইওনার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন হ্যামিশ লাফিয়ে উঠে তাকে বাধা দিল। তিন বন্ধুর মধ্যে এক ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল, আর সেই ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের মাঝখানে জ্বলজ্বলে ফেইরি পাথরটি যেন হাসছিল। তারা বুঝতে পারছিল না, তাদের মধ্যে কে সত্য বলছে, কে মিথ্যা বলছে। কারণ অভিশাপ তাদের সবাইকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। এইবার তাদের সিদ্ধান্ত শুধু অভিশাপ ভাঙার জন্য নয়, বরং কে বাঁচবে আর কে মরে যাবে, তার জন্য।
ভয় এবং সন্দেহ অ্যালেক্সকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়েছিল। সে ইওনাকে লক্ষ্য করে পাথরের টুকরো ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছিল, আর হ্যামিশ তাকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। তাদের বন্ধুত্ব এক নিমিষে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, আর এর কারণ ছিল সেই অভিশাপ যা তাদের মনের গভীরে বাসা বেঁধেছিল।
"অ্যালেক্স! তুমি কী করছো?" হ্যামিশ চিৎকার করে বলল। কিন্তু অ্যালেক্স তার কথা শুনছিল না। তার চোখ দুটি উন্মত্ততায় জ্বলছিল, আর সে কেবল তার নিজের মনের মধ্যে থাকা সেই অশরীরী কণ্ঠস্বরের আদেশ মানছিল। অ্যালেক্স হ্যামিশকে সরিয়ে দিয়ে ইওনার দিকে এগিয়ে এল।
ঠিক তখনই, হ্যামিশের গলায় ঝুলন্ত একটি পুরনো লকেট জ্বলজ্বল করে উঠল। লকেটটি ছিল তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া, যারা এই অভিশাপ সম্পর্কে জানত। লকেটের আলোয় হ্যামিশের চোখের সামনে একটি ছবি ভেসে উঠল। সে দেখতে পেল তার পূর্বপুরুষকে, যে মানচিত্রটি তৈরি করেছিল, এবং তার পাশে দাঁড়িয়েছিল সেই অ্যালিস্টার। সে দেখতে পেল, অ্যালিস্টার আসলে লোভের শিকার নয়, বরং সে ভয় এবং নিজের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত ছিল। তার আত্মাকে তার পাপের জন্য অভিশাপ দেওয়া হয়নি, বরং তার ভয় এবং কাপুরুষতার জন্য এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, যেন সে অনন্তকাল ধরে সেই ভয়ের শিকার হয়।
হ্যামিশের মনে এক নতুন শক্তি এবং দৃঢ়তা জন্ম নিলো। সে চিৎকার করে বলল, "অ্যালেক্স, থামো! এই অভিশাপ আমাদের লোভের জন্য নয়, আমাদের ভয়ের জন্য! আত্মত্যাগ মানে জীবন নয়, ভয়কে জয় করা! আমাদের লোভ এবং ভয়কে এই পাথরের কাছে উৎসর্গ করতে হবে, নিজেদের জীবন নয়!"
হঠাৎ হ্যামিশের কণ্ঠে এক আশ্চর্য ক্ষমতা অনুভব করে অ্যালেক্স থমকে দাঁড়াল। লকেটের আলোয় তার উন্মত্ত চোখ শান্ত হয়ে গেল, এবং সে বুঝতে পারল যে সে কী করতে যাচ্ছিল। তার মাথা থেকে সেই অশুভ কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। অ্যালেক্স ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। সে লজ্জিত এবং ক্লান্ত হয়ে গেল।
ইওনা এবং হ্যামিশ দ্রুত তার কাছে গেল। অ্যালেক্স অপরাধীর মতো বলল, "আমি...আমি কী করছিলাম? আমি বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করে দাও আমাকে।"
ইওনা তার হাত ধরে বলল, "এটা তোমার দোষ নয়, অ্যালেক্স। এটা অভিশাপের প্রভাব।"
তারা তিনজন আবার একত্রিত হলো, তাদের বন্ধুত্ব এখন আরও শক্তিশালী। তারা বুঝতে পারল যে এই অভিশাপের আসল উৎস মানুষের লোভ এবং ভয়। আত্মত্যাগের অর্থ ছিল নিজেদের সেই সব নেতিবাচক আবেগগুলোকে ফেইরি পাথরের কাছে উৎসর্গ করা, যেন সেই পাথর আবার শুদ্ধ হতে পারে। তারা এবার স্ক্রলের দিকে তাকাল, এবং ইওনা বুঝতে পারল, প্রতিটি মন্ত্রের আসল অর্থ কী। এটি কোনো মৃত্যুর মন্ত্র ছিল না, ছিল শুদ্ধি এবং বিশ্বাসের মন্ত্র। তারা তিনজন এক নতুন আশা নিয়ে ফেইরি পাথরের দিকে তাকাল। তাদের সামনে ছিল শেষ লড়াই, যা তাদের নিজেদের ভিতরের শয়তানের সাথে।
ইওনা, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ, তিন বন্ধু ফেইরি পাথরের সামনে এক নতুন সংকল্প নিয়ে দাঁড়াল। তাদের হৃদয়ে এখন আর ভয় ছিল না, ছিল শুধু একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং এই অভিশাপকে চিরতরে শেষ করার দৃঢ় ইচ্ছে। তারা বুঝতে পারল, এই মন্ত্রটি শুধু কিছু শব্দ নয়, এটি তাদের মনের ভেতরের লোভ এবং ভয়কে অতিক্রম করার একটি উপায়।
ইওনা হাতে ধরা স্ক্রলটি থেকে মন্ত্রটি পড়তে শুরু করল। প্রতিটি শব্দ যেন এক প্রাচীন শক্তিকে জাগ্রত করছিল। মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ ফেইরি পাথরের ওপর তাদের হাত রাখল, আর তাদের সমস্ত শক্তিকে মন্ত্রের মাধ্যমে পাথরের দিকে প্রবাহিত করতে শুরু করল।
পাথরটি প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে লাগল। পাথর থেকে এক ভয়ঙ্কর শক্তি বের হয়ে আসছিল, যা তাদের শেষবারের মতো ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল। ক্লাকফরেস্টের প্রতিটি গাছ হিংস্রভাবে কাঁপতে শুরু করল, আর চারপাশের বাতাস আবার সেই ভয়ানক অশরীরী হাসিতে ভরে উঠল। অ্যালিস্টারের আত্মা আবার তাদের সামনে ভেসে উঠল, এবার তার চোখে ছিল যন্ত্রণা আর ক্রোধ। অভিশাপটি তাদের বাধা দিতে চাইছে, কিন্তু তারা আর পিছু হটবে না।
ইওনা উচ্চস্বরে মন্ত্র পাঠ করছিল, অ্যালেক্স এবং হ্যামিশ তাদের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে পাথরের দিকে তাদের হাত চেপে ধরেছিল। তারা তাদের ভয় এবং সন্দেহকে নিজেদের মন থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল। তারা মনে মনে নিজেদের যাত্রা, তাদের বন্ধুত্ব এবং এই অভিশাপের পেছনের সত্যের কথা ভাবছিল। তাদের সম্মিলিত শক্তি ছিল অভিশাপের থেকেও শক্তিশালী।
যখন ইওনা মন্ত্রের শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করল, তখন ফেইরি পাথর থেকে এক তীব্র, উজ্জ্বল সাদা আলো বিস্ফোরিত হলো। সেই আলো সমগ্র ক্লাকফরেস্টকে গ্রাস করল, অন্ধকার, ভয় এবং অভিশাপের প্রতিটি চিহ্ন মুছে দিল। আলো এতই শক্তিশালী ছিল যে তাদের চোখ বন্ধ করে ফেলতে হলো।
যখন তারা আবার চোখ খুলল, তখন দেখতে পেল যে ফেইরি পাথরটি আর জ্বলছে না। তার উপর থেকে অদ্ভুত শক্তি মুছে গিয়েছিল, এবং এর চারপাশে অদ্ভুত আলো আর অশুভ বাতাস ছিল না। তাদের সামনে আবার অ্যালিস্টারের আত্মা ভেসে উঠল, কিন্তু এবার তার মুখ ছিল শান্ত এবং তার চোখে ছিল এক গভীর কৃতজ্ঞতা। তার আত্মা ধীরে ধীরে সেই উজ্জ্বল আলোর মধ্যে মিশে গেল, আর সে তার চিরন্তন শান্তি খুঁজে পেল।
ক্লাকফরেস্টের পরিবেশ সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে গিয়েছিল। পাখির ডাক এবং গাছের পাতা নড়ার শব্দে বনটি আবার তার স্বাভাবিক রূপে ফিরে এসেছিল। সেই খাদের পাশে গিয়ে তারা দেখল, সেটি আর গভীর নয়, বরং এর উপর একটি পুরনো, কিন্তু নিরাপদ রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। তারা তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারা জানত যে তারা একটি অসম্ভব কাজ সম্পন্ন করেছে।
তারা ক্লাকফরেস্ট থেকে বেরিয়ে এলো, কিন্তু তাদের আর আগের মতো ছিল না। তারা এখন সেই গোপন রহস্যের রক্ষক, যা তাদের জীবনকে চিরদিনের জন্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। তারা গ্লেনফিন্নানের দিকে ফিরে গেল, যেখানে তাদের জন্য এক নতুন জীবন অপেক্ষা করছিল, আর তাদের পেছনে ছিল সেই বন, যা তাদের সাহসিকতার সাক্ষী হয়ে চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকবে।
•••• সমাপ্ত ••••
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder