কাব্যগ্রন্থ: দশমিকের আগুনে পুড়ে গেছে স্মৃতির পাতা
নক্ষত্রের ভিতর নীরবতা
তারাদের ঝুড়িতে ভরে রেখেছি কণ্ঠহীন ডাক,
পাথরের ঘুমে ডুবে গেছে পুরনো আলাপন,
তোমার নাম উচ্চারণে ভেঙে যায় সময়ের কাচ,
ফিরে আসে ধুলোর শহরে অচেনা বাতাসের মন।
নক্ষত্রের ধুলোয় লেখা ছিল এক প্রাচীন মানচিত্র,
যেখানে পথ কেবলই ফিরে যায় না-ফেরার দেশে,
সেই মানচিত্রে জলরঙের মতো মিশে আছে অবিরাম ক্ষত,
আর ঘুমন্ত নদীর বুক থেকে ওঠে বিক্ষিপ্ত রেশে।
কেউ জানে না নীরবতার ভেতরে কতটা শব্দ লুকানো,
কেউ জানে না ছায়ার পিঠে কতটা সূর্যের ভর,
আমি শুধু জানি—তোমার অনুপস্থিতি
আমার বুকের ভেতরে খোদাই করেছে
একটি নক্ষত্রপুঞ্জের নীরব আকার।
শীতের ভোরে ছাইরঙা ডাকপিয়ন
শীতের কুয়াশায় দাঁড়িয়ে আছে এক ছাইরঙা ডাকপিয়ন,
চিঠির খামে জমে গেছে কাঁপা-আঙুলের ছাপ,
সে চিঠি কারো কাছে যাবে না—
পাঠানো হয়নি এমন শহরে যে শহর কেবল কল্পনায় বাঁচে।
রাস্তার বাতি ঝিমোচ্ছে, কুকুরের চোখে নীল তুষার,
দূরে কোথাও বাজছে অসমাপ্ত ভজন,
ডাকপিয়নের চোখে গলে যাচ্ছে রাতের ধাতব আলো,
আর খামের ভিতর শব্দেরা ঘুমাচ্ছে বিনা ঠিকানায়।
আমি জানি—
যে চিঠি পড়া হয় না,
সে চিঠিই সবচেয়ে বেশি কাঁদে,
কারণ তার ভিতরে থাকে এমন শব্দ
যেগুলো একবার বেরোলেই
ফিরে যায় না আর কোনো শীতের ভোরে।
কুয়াশালিপি
ভোরের মুখে জমেছে কুয়াশালিপি,
যেখানে শব্দেরা অক্ষরের মতো নয়,
বরং শ্বাসের মতো—
যা দেখা যায় না কিন্তু অনুভূত হয় গভীরে।
তোমার হেঁটে যাওয়ার শব্দ
আমার জানালার কাঁচে জমে থাকা শিশিরে আঁকা,
তুমি কখনও বুঝবে না,
একজন মানুষ কিভাবে নিজের ছায়াকে
ধরে রাখে ভেজা আঙুলে।
এই কুয়াশা কেটে গেলে
আকাশ হবে স্বচ্ছ,
কিন্তু আমার চোখে তখনও থাকবে
এক টুকরো ধোঁয়া—
যার ভিতরে তুমি হেঁটে যাবে
অদৃশ্য শহরের দিকে।
ঘড়ির ভিতর নোনাজল
দেয়ালে ঝুলে থাকা পুরনো ঘড়ির ভিতরে
টিকটিক শব্দ নয়,
বাজছে নোনাজলের ঢেউ।
প্রতিটি সেকেন্ড
কেটে যাচ্ছে একেকটি সাগরদ্বীপ ভিজিয়ে,
আর আমি বসে আছি তীরে
যেন অপেক্ষাই আমার একমাত্র কাজ।
সময় থেমে যায় না,
কিন্তু মনে হয়
তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে
ঘড়ির কাঁটা আসলে
একই জায়গায় ঘুরছে—
যেখানে তুমি বিদায় বলেছিলে
আর সমুদ্রের গন্ধ ঢুকে পড়েছিল
আমার বুকের ভেতর।
ধ্বংসস্তূপে পায়ের শব্দ
শহরের মাঝখানে এক ধ্বংসস্তূপ,
ভাঙা ইট, ছেঁড়া ক্যালেন্ডার,
আর শুকনো রঙের দেয়ালে
আধখাওয়া কবিতার আঁচড়।
আমি পা রাখি ধীরে—
যেন প্রতিটি ইট মনে রাখে
আমার পদধ্বনির নকশা,
যেন ভাঙা জানালা দেখে
আমার চোখের ভিতরে শহরের শেষ আলোকছবি।
ধ্বংস মানে শেষ নয়—
এটাও এক ধরনের আর্কাইভ,
যেখানে জমে থাকে প্রতিটি ফিসফিস,
প্রতিটি পদচিহ্ন,
প্রতিটি অনুচ্চারিত অভিমান,
যা একদিন হয়তো
কোনো নতুন শহরের দেয়ালে
লেখা হবে প্রথম কবিতা হয়ে।