অদিতি প্রদীপ হাতে এগিয়ে চলল গ্রামের বাইরে ঘন জঙ্গলের দিকে। বাতাসে অদ্ভুত কাঁপুনি, পেঁচার ডাক, আর গাছের ডাল ভেঙে পড়ার শব্দে চারপাশ ভরে আছে। গ্রামের প্রবীণরা বলেছিল—
“স্বপ্নফুল ফোটে কেবল বনমধ্যের অশ্রুকূপে।”
কিন্তু অশ্রুকূপে পৌঁছাতে হলে প্রথমে পার হতে হয় অন্ধকার বনের ভেতর, যেখানে নাকি ছায়ারা ঘোরাফেরা করে।
অদিতি ভয় পেলেও থামল না। তার মনে শুধু অর্ণব।
“তুমি অপেক্ষা করো… আমি আসছি।”
ওদিকে আয়নার জগতে অর্ণব হঠাৎ দেখল চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। নদীর জল একেবারে স্থির, আয়নায় শুধু তার নিজের প্রতিবিম্ব।
কিন্তু হঠাৎ সেই প্রতিবিম্ব নড়ল—এবং তার সামনে দাঁড়াল আরেক অর্ণব।
প্রতিবিম্ব-অর্ণব হাসল শীতল কণ্ঠে।
“তুমি ভাবো তুমি রক্ষক? আমি তোমারই ছায়া। তোমার ভিতরের ভয়, সন্দেহ আর দুর্বলতা আমি।”
অর্ণব মুষ্টি শক্ত করল।
“তুমি আমার ভেতরে থাকতে পারো, কিন্তু আমি তোমাকে জিততে দেব না।”
দুজনের মধ্যে শুরু হলো ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্ব।
অদিতি বনের ভেতর যত এগোচ্ছে, ততই বাতাস ভারী হচ্ছে। চারপাশে ছায়ামূর্তির মতো কিছু দৌড়ে যাচ্ছে, আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ সামনে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এল। তার লম্বা সাদা দাড়ি, হাতে কাঠের লাঠি।
“মেয়ে, তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
অদিতি থেমে বলল—
“আমি অশ্রুকূপের খোঁজে এসেছি। স্বপ্নফুল পেতে হবে আমাকে।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।
“স্বপ্নফুল সহজে পাওয়া যায় না। তা কেবল ফুটবে যখন তুমি নিজের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতিকে হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করবে।”
অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
“আমি তো অর্ণবকে হারিয়েছি। আর কী হারাতে হবে?”
বৃদ্ধ শুধু একবার দুঃখী চোখে তাকালেন, তারপর জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
আয়নার ভেতরে অর্ণবের ছায়া-প্রতিবিম্ব হেসে উঠল।
“তুমি অদিতিকে বাঁচাতে চাও, কিন্তু তার সত্যিকারের সুখ কি তুমি নিশ্চিত করতে পারবে? যদি সে তোমাকে ভুলে যায়? যদি অন্য কারও জীবনে সে শান্তি খুঁজে পায়?”
অর্ণবের বুক চিরে গেল। সেই ভয়টা যেন সত্যি।
কিন্তু সে দাঁত চেপে বলল—
“ভালোবাসা মানে বাঁধন নয়। যদি অদিতি অন্য কোথাও সুখ পায়, তাতেও আমি খুশি হব। কারণ আমি চাই সে বাঁচুক।”
এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে আলো ঝলসে উঠল। ছায়া-প্রতিবিম্ব চিৎকার করে মিলিয়ে গেল।
অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। কিন্তু তার চোখে শান্তি ফুটে উঠল।
“এটাই আমার সত্য।”
অদিতি বহুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ দেখতে পেল সামনে একটি প্রাচীন পাথরের বৃত্ত। মাঝখানে ছোট্ট এক কূপ, যার জল কালো, অথচ ভেতর থেকে মৃদু আলো বেরোচ্ছে।
সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কূপের পাশে মাটির গায়ে খোদাই করা আছে—
“যে অশ্রু সত্য ভালোবাসা থেকে ঝরে, তার ফোঁটাতেই ফোটে স্বপ্নফুল।”
অদিতির চোখে জল ভরে উঠল। সে কূপের দিকে তাকিয়ে বলল—
“অর্ণব, তোমাকে ছাড়া প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে মৃত্যুর মতো। যদি আমার ভালোবাসা সত্যি হয়, তবে আজই ফুটুক সেই ফুল।”
অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই কূপের ভেতর আলো তীব্র হয়ে উঠল। হঠাৎ এক অদ্ভুত সাদা ফুল ভেসে উঠল জলের উপর, যার পাপড়ি যেন আলো দিয়ে তৈরি।
অদিতি হাত বাড়িয়ে তুলে নিল ফুলটি। সঙ্গে সঙ্গেই বনের অন্ধকার একটু হালকা হয়ে গেল।
কিন্তু সে ফুল হাতে নিয়েই দাঁড়াতেই পিছন থেকে শীতল কণ্ঠ ভেসে এল—
“তুমি সত্যিই প্রথম রহস্য পেয়ে গেছ। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিটি রহস্যের পাহারাদার আছে।”
অদিতি ঘুরে তাকাল। দেখল এক অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে—তার চোখ গভীর কালো, মুখে মৃদু হাসি।
“আমি কে, জানতে চাইছ? আমি সপ্ত রহস্যের পথিক। কেউ বলে আমি রক্ষক, কেউ বলে ধ্বংসকারী। কিন্তু আমি ঠিক করব, তোমাকে সা
হায্য করব কি না।”
অদিতির হাতে তখন জ্বলজ্বল করছে স্বপ্নফুল।
( চলবে...)
