শাদা খাতা
অভিজিৎ হালদার
আশফাক আর ইমতিয়াজ। দু'জনের বন্ধুত্বটা ছিল বড় অদ্ভুত। অনেকটা রেললাইনের মতো। পাশাপাশি চলে, কিন্তু কখনও এক হয় না। আশফাক ছিল শান্ত, সংবেদনশীল, আর তার মনটা ছিল এক শাদা খাতার মতো। যা কিছু দেখত, যা কিছু অনুভব করত, সব সে সেই শাদা খাতায় এঁকে নিতো। তার আঁকায় ছিল এক অন্যরকম জাদু। আর ইমতিয়াজ ছিল ঝড়ের মতো। অস্থির, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আর তার চোখ দুটো যেন সবসময় নতুন দিগন্তের খোঁজে ব্যস্ত। তার কাছে জীবন মানে ছিল জয় করা, শুধু জয় করা।
কলেজের প্রথম দিনেই তাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে আশফাক যখন একমনে তার ডায়েরিতে কিছু একটা আঁকছিল, ইমতিয়াজ এসে তার পাশে বসেছিল। “কী আঁকছিস?” ইমতিয়াজের কথায় চমকে উঠেছিল আশফাক। সে ইতস্তত করে তার ডায়েরিটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ইমতিয়াজ তার আগেই দেখে ফেলেছিল। একটা ভাঙা জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া পুরোনো রেললাইনের ছবি। সেখানে একটা শালিক বসে ছিল।
“বাহ! তুই তো দারুণ আঁকিস!” ইমতিয়াজ বলেছিল।
সেই শুরু। তারপর থেকে তারা হয়ে উঠেছিল একে অপরের পরিপূরক। আশফাকের শাদা খাতা আর ইমতিয়াজের ঝড়ের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আশফাক তার আঁকায় ইমতিয়াজের স্বপ্নগুলোকে ফুটিয়ে তুলত, আর ইমতিয়াজ আশফাককে উৎসাহিত করত তার শিল্পকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যেতে।
কলেজ শেষ হওয়ার পর আশফাকের জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এল। তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ল তার কাঁধে। তার শিল্পচর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সে একটা ছোটখাটো চাকরি নিল, যা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তার সেই শাদা খাতাটা চাপা পড়ে রইল ঘরের এক কোণে।
অন্যদিকে, ইমতিয়াজ তার স্বপ্ন পূরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, শুধু প্রতিভার উপর নির্ভর করে লাভ নেই। দরকার ছিল সঠিক প্ল্যাটফর্ম। সে আশফাকের কাছে এল। “আশফাক, তোর আঁকাগুলো সব আমাকে দে।” ইমতিয়াজের প্রস্তাবে আশফাক প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিল। “কেন?” সে জিজ্ঞেস করল।
“আমি একটা আর্ট গ্যালারি খুলতে চাই। কিন্তু আমার কাছে কোনো ভালো আঁকা নেই। তোর আঁকাগুলো আমি সেখানে ডিসপ্লে করব। আমাদের দুজনের নাম হবে। তোর শিল্প আর আমার ব্যবসা, মিলেমিশে আমরা এক নতুন ইতিহাস গড়ব।” ইমতিয়াজের চোখে তখন হাজারো স্বপ্ন। আশফাক দ্বিধা করল না। তার বন্ধু, তার সেই ঝড়ের মতো ইমতিয়াজ তার কাছে এমন এক সুযোগ নিয়ে এসেছে, যা তার স্বপ্নকে আবার জীবিত করতে পারে। সে তার শাদা খাতার সব আঁকা ইমতিয়াজকে দিয়ে দিল।
ইমতিয়াজ তার পরিকল্পনা মতো কাজ শুরু করল। সে একটা ছোট আর্ট গ্যালারি ভাড়া নিল। নাম দিল, “আঁকিয়ে”। আশফাকের আঁকাগুলো গ্যালারির দেয়ালে সাজিয়ে দিল। প্রথমে কেউ আসত না। কিন্তু ইমতিয়াজ হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিভিন্ন গ্রুপে, নানাভাবে গ্যালারির প্রচার করতে লাগল। এক সময় তার চেষ্টা ফল দিল। একজন বিখ্যাত চিত্র সমালোচক গ্যালারিতে এলেন। আশফাকের আঁকা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
তিনি ইমতিয়াজকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই আঁকার স্রষ্টা কে?”
ইমতিয়াজ হেসে বলল, “আমি।”
আশফাকের নাম সে একবারও উচ্চারণ করল না। সেই চিত্র সমালোচক ইমতিয়াজের আঁকার প্রশংসা করে একটি বড় পত্রিকায় লিখলেন। তারপর রাতারাতি ইমতিয়াজ হয়ে গেল এক নামকরা চিত্রশিল্পী। সবাই তাকে চিনতে শুরু করল। তার আঁকা চড়া দামে বিক্রি হতে লাগল। তার সেই শাদা খাতাগুলো এখন রঙিন হয়ে উঠল। সে আর কোনোদিন আশফাকের কথা বলল না।
আশফাক এই সব খবর শুনতে পেত। তার মনটা প্রথমে একটু খারাপ হয়েছিল, কিন্তু সে ভাবল, "ইমতিয়াজ যদি ভালো থাকে, তার স্বপ্ন যদি পূরণ হয়, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই।" সে তখনও তার বন্ধুকে বিশ্বাস করত।
একবার একটা বড় আর্ট প্রদর্শনীতে আশফাক গেল। সেখানে ইমতিয়াজের স্টল ছিল। ইমতিয়াজ তার নিজের আঁকা বলে আশফাকের আঁকাগুলো প্রদর্শন করছিল। এক কোণে দাঁড়িয়ে আশফাক সব দেখছিল। ভিড়ের মধ্যে ইমতিয়াজ তাকে দেখতে পেল। ইমতিয়াজ যেন তাকে দেখতে পায়নি, এমন ভান করল। আশফাক তার কাছে গেল।
“ইমতিয়াজ, তোর এই সাফল্যে আমি খুব খুশি।” আশফাক বলল।
ইমতিয়াজ যেন একটু চমকে উঠল। “আরে আশফাক, তুই এখানে? কেমন আছিস?”
“ভালো আছি। কিন্তু একটা কথা, তোর এই আঁকাগুলো… এগুলো তো আমার আঁকা। তুই কেন নিজের নাম দিচ্ছিস?” আশফাক জিজ্ঞেস করল।
ইমতিয়াজ হাসল। “কী বলছিস তুই? এগুলো আমার আঁকা। তুই কী করে জানিস?”
আশফাক হতবাক হয়ে গেল। “কী বলছিস? আমি তোকে আমার সব আঁকা দিয়েছিলাম। সেই শাদা খাতা…”
ইমতিয়াজ তাকে থামিয়ে দিল। “আশফাক, আমার মনে হয় তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি কোনো শাদা খাতাটাতা চিনি না। আর তোর আঁকার স্টাইল আমার আঁকার স্টাইলের সাথে মেলে না। সবাই তো জানে আমিই এগুলোর স্রষ্টা।”
আশফাকের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। তার চোখের সামনে তার বন্ধু, যাকে সে তার সবচেয়ে বড় সম্পদ দিয়েছিল, সেই তাকেই অস্বীকার করছে। আশফাক ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসল। তার সেই হাসিটা ছিল বড় করুণ। সে বুঝতে পারল, তার শাদা খাতাটা আর কোনোদিন শাদা থাকবে না। সেখানে যে কালো দাগটা পড়ে গেছে, সেটা আর কোনোদিন মুছে যাবে না।
আশফাক কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে এল। তার সেই শাদা খাতাটা এখন শুধু একটা স্মৃতি। একটা তিক্ত স্মৃতির প্রতীক। সে বুঝতে পারল, ইমতিয়াজের কাছে বন্ধুত্ব ছিল একটা সিঁড়ি। তার স্বপ্নের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে সে আশফাককে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
আশফাক তার ঘরে ফিরে এল। তার সেই শাদা খাতাটা সে খুঁজে বের করল। সে খাতাটা খুলল। সেখানে একটি নতুন ছবি আঁকতে শুরু করল। একটি শাদা খাতা, যা এখন আর শাদা নেই। তার উপর একটা কালো দাগ, যা বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন। সে তার শিল্প দিয়ে তার কষ্টকে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আঙুল থেকে কোনো রঙ আসছিল না। তার সেই সংবেদনশীল মনটা এখন পাথর হয়ে গেছে।
আশফাক তার সেই শাদা খাতাটা বন্ধ করে দিল। সে বুঝেছিল, কিছু মানুষের কাছে বন্ধুত্ব শুধু প্রয়োজন। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তারা তোমাকে ছুড়ে ফেলে দেবে। আশফাক তার সেই শাদা খাতার মতো শাদা মনের মানুষটাকে হারিয়ে ফেলল। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতটা ছিল তার বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা। আর সেই ক্ষতটা কোনোদিন সারবে না।