পালঙ্ক
সরজিৎ ঘোষ
বিয়ের পরের দিন তখনো পর্যন্ত বাড়িতে আত্মীয় স্বজন অনেকেই আছেন। সেন বাড়ির বিয়ে মানে চার পাঁচদিন তো হৈ হুল্লোড় চলবেই। সন্ধ্যে বেলায় বাড়ির সবাই মিলে নতুন বৌকে নিয়ে আড্ডায় মেতেছে। নতুন বৌ মানে পৌলমী। সেন বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে মাত্র দু'দিন হলো। পৌলমীও সকলের সাথে তখন হেসে হেসে কথা বলে চলেছে। সেই মুহুর্তে সুতনুকা ফোন করে বসে পৌলমীকে। সুতনুকা মানে পৌলমীর মা। অগত্যা পৌলমীকে সকলের মাঝখান থেকে চাঁদের হাট ভেঙে একপ্রকার উঠে আসতেই হয়।
পৌলমী বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। বাবা নিরঞ্জন লাহিড়ী ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। মা সুতনুকা লাহিড়ীও ভালো চাকরি করেন। দুই বাড়িতে দেখাশোনা করেই পৌলমীর বিয়ে হয় বিক্রমের সাথে।
সেন বাড়ির ছেলে এই বিক্রম। বিক্রমজিৎ সেন। সবাই বিক্রম বলেই ডাকে। উত্তর কলকাতার এক বনেদী বাড়ি হলো এই সেন বাড়ি। এক কালে ভীষণ নাম ডাক ছিল সেন বাড়ির। একান্নবর্তী পরিবারে ছিল তখন তিরিশ জন সদস্য। তবে সেই একান্নবর্তী পরিবার আজ নেই, এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয়ে গেছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ছোটো পরিবার হলেও মাঝে মধ্যেই বাড়ির সকলে এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার রীতিটা কিন্তু আজও বজায় আছে। বাড়িতে ছোটো খাটো অনুষ্ঠান তো প্রায় লেগেই থাকে। আজ জন্মদিন তো কাল বিবাহবার্ষিকী। একটার পর একটা চলতেই থাকে।একটা মাসের মধ্যে দু তিনটে ছোটো খাটো অনুষ্ঠান না হলে সেন বাড়ি যেন জমে না।
বিক্রমদের এখন ছোটো পরিবার। বাবা,মা ও বিক্রম। বিক্রম কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরে। দিদির বিয়ে হয়েছে সাত বছর আগেই। বাবা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। দুবছর হলো রিটায়ার করেছেন। বিক্রমের মা অবশ্য হাউস ওয়াইফ।
বিক্রমকে দেখে পছন্দ করেন পৌলমীর মামা।এমনিতেই বিক্রম বেশ নম্র। পৌলমীর মামা বিক্রমের ব্যাপারে ফোন করে দিদি সুতনুকা'কে জানিয়েছিল। সুতনুকা বলেছিল,ভালো ছেলে হলে আমাদের আপত্তি নেই।
পৌলমী সুন্দরী। কম কথা বলা লাজুক মেয়ে।কারো সাথে একবার পরিচয় হয়ে গেলে কী করে আপন করে নিতে হয় সেটা পৌলমী ভালো করেই জানে। জুলজিতে এম.এস.সি করেছে। তবে পৌলমী এখনও চাকরি পায়নি।
ছোটো থেকেই পৌলমী কড়া শাসনে মানুষ। বন্ধু বান্ধবীদের সংখ্যা নিতান্তই অল্প। পড়াশোনা আর গান বাজনা এই নিয়েই তার জগৎ। বাইরের জগতের সঙ্গে পৌলমীর মেলা মেশাটা একটু কম। তার কারণ পৌলমীর মা বাবা পছন্দ করত না পৌলমী বাইরের কারো সাথে মিশুক। ইচ্ছে থাকলেও কখনো কারোর সাথেই প্রেম করা হয়ে ওঠেনি। প্রেমের প্রস্তাব যে পায়নি এমনটা নয়। প্রেম করলেও সেটা পৌলমীর মা বাবা মেনে নেবে না সেটা পৌলমী ভালো ভাবেই জানত। তাই কারোর সাথে প্রেম করে সেই সৎ সাহস দেখাতে পারেনি পৌলমী। অনেকেই ভাবে পৌলমী হয়তো অহংকারী। এমন কথাও পৌলমীকে শুনতে হয়েছে,"সুন্দরী বলে মাটিতে পা পড়ে না।" পৌলমী আসলে এমনটা নয়। পৌলমীর জগৎটাকেই সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। আর সেই দায় এখন পৌলমীর ওপর এসেই পড়ে, একথা পৌলমী কাকেই বা বলে বোঝাবে? মনের মধ্যে একটা চাপা যন্ত্রণা দীর্ঘদিন ধরেই বয়ে চলেছে। নিয়মের বেড়াজালে শৈশবটাকে উপভোগ করতেই পারেনি। মা হচ্ছে সন্তানের প্রথম পাঠশালা। সেভাবে পৌলমী কখনো মা'কেই পায়নি।
তবে বিয়ের কথা পৌলমীর বাবা মা যখন ভাবতে শুরু করলো তখন থেকেই পৌলমী মনে প্রাণে চেয়েছিল একটা ভালো পরিবার যেন সে পায়। সেখানে যেন নিজেকে মেলে ধরতে পারে অন্তত। এক দম বন্ধ করা জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছিল পৌলমী। বিক্রমদের বাড়ি থেকে যেদিন পৌলমীকে দেখতে এসেছিল তখন একসঙ্গে সাত আটজন এসেছিলেন। একসঙ্গে এতজন মানুষকে দেখে পৌলমীর বেশ ভালো লেগেছিল। সুতনুকা অবশ্য খুশি হয়নি তাতে। পৌলমী বুঝেছিল এতজন মানেই পরিবারের সকলের সাথে একটা আত্মিক যোগ অবশ্যই আছে, যেটা পৌলমীদের বাড়িতে নেই। প্রথম দেখাতেই বিক্রমকে খারাপ লাগেনি পৌলমীর। বেশ দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ বলতে হয়। পৌলমী বোধহয় এমন কাউকেই চেয়েছিল। বিয়ে আসলে বিধির বিধান, যার সাথে লেখা আছে তার সাথে হবেই।
দুই বাড়িতেই যখন পছন্দ হয়ে গেল তখন বিয়ের পাকা কথার জন্য বিক্রমদের বাড়ি থেকে সকলেই এসেছিল। পৌলমীর বাবা নিরঞ্জন বাবু দেনা পাওনার কথা যখন জিজ্ঞেস করছিলেন তখন বিক্রমের বাবা বলেছিলেন,
-আমাদের বাড়িতে এই রীতি নীতিটাই নেই। আমাদের মেয়ের বিয়ে হলে পণ যেমন দেব না, তেমনি ছেলের বিয়েতে পণ সামগ্রী নেব না। বিয়ে মানে সম্পর্ক। বিয়ে মানে আত্মীয়তা। দর দাম কেনা বেচা নয়।
এমন কথা শুনে পৌলমীর ভালো লেগেছিল বেশ। তবে পৌলমীর বাবা বলেছিলেন,
-কিছু না নিলেও যতদূর জানি বিয়েতে একটা শয্যা দিতেই হয়। আমি কিন্তু সেটি দেব।
এমন কথা শুনে বিক্রম বলেছিল,
-না না ওটাও লাগবে না। আমাদের বাড়িতে ওসব আছে। আমার দাদুর দেওয়া পালঙ্ক। বলতে গেলে বহু পুরানো। আমার দাদু সেই সময়ে বাড়িতে মিস্ত্রী এনে বানিয়ে ছিলেন। দাদু ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর ওটাই এখন আমার। তাই ওটাও লাগবে না।
বিক্রমের এমন কথায় সায় দেয়নি পৌলমীর মা সুতনুকা। পৌলমীর মা বলেছিলেন,
--তোমাদের নতুন জীবন শুরু হবে নতুন সব কিছু দিয়ে। এই শুভ কাজে ওই পালঙ্ক টালঙ্ক দরকার নেই। তাছাড়া ওটা তোমার দাদু ঠাকুমার ব্যবহার করা খাট। মৃত মানুষদের জিনিস কোথায় অমঙ্গল টমঙ্গল হবে! তার থেকে বরং ওটার দরকার নেই।আমরা মনের মতো করে আধুনিক ডিজাইনের খাট বানিয়ে দেব।
এমন কথাতে অবশ্য বিক্রমের বাবাও সায় দিয়েছিলেন। বিক্রম বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারেনি । বিক্রমের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অবশেষে বিয়ের দিনক্ষণ স্থির হয়। শুভ দিনেই পৌলমীর সাথে বিক্রমের বিয়েটা হয়।
বিক্রমের বৌ হয়ে পৌলমী আসে সেন বাড়িতে।পরের দিন পৌলমীর বৌভাতের অনুষ্ঠান। বাড়িতে হৈ হৈ রব। পৌলমীকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। বিয়ের পর নতুন সাজে পৌলমী আরো যেন সুন্দরী হয়ে উঠেছে। কন্যা যাত্রীও এসেছে। সুতনুকাও এসেছেন মেয়ের বিয়ের রিসেপশনের অনুষ্ঠানে। হঠাৎ সতনুকার মেজাজটা বিগড়ে যায়। ঘরে ঢুকে যখন দেখেছে পৌলমীর ঘরে যে খাটটি সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে, সেটি তাদের দেওয়া খাট নয়, বিক্রমের দাদুর সাবেক আমলের সেই পালঙ্কটিই সেজে উঠেছে নতুন সাজে। এতেই অগ্নিশর্মা হয়ে কোনো কিছু খাওয়া দাওয়া না করেই বাড়ি থেকে চলে যান সুতনুকা। যাবার আগে পৌলমীর মা যখন পৌলমীকে জিজ্ঞেস করেছিল, পৌলমী তখন বলেছিল,পরে ফোন করে তোমাকে সব জানাবো।
আসলে বৌভাতের দিন সকালে বিক্রমের ঘর থেকে পালঙ্কটা খুলে যখন নতুন বক্স খাটটা পাতার আয়োজন চলছে তখন পৌলমীই বলেছিল,
-পালঙ্কটা এই ঘরেই থাকবে। এছাড়াও পাশে তো আরো একটা ঘর আছে। বক্স খাটটা বরং ওই ঘরেই থাকুক।
এমন কথা শুনে বিক্রম অবাক হয়ে যায়। বিক্রম বলে,
-না না পালঙ্কটা পাশের ঘরে থাকুক। বক্স খাটটা না থাকলে খারাপ দেখায়।
-কোনো কিছু খারাপ দেখাবে না আমি তো বলছি!
পৌলমী পালঙ্কটা বের করতে দেয় নি। পৌলমীর কথা মতো পৌলমীর বাবার দেওয়া বক্স খাটটা পাশের ঘরেই রাখা হয়।
পরে বিক্রম পৌলমীকে জিজ্ঞেস করেছিল,
-পৌলমী তুমি এটা করলে কেন?
পৌলমী বলেছিল,
-আমি জানি এই পালঙ্কটাই তোমার ভীষণ প্রিয়। পাকা দেখার দিন আমার মা যখন বলেছিল, ওটা তো মৃত মানুষদের পালঙ্ক, ওটা শুভ কাজে চলে না তখন মায়ের মত মেনে নিতে পারিনি। সেই সঙ্গে প্রতিবাদও করতে পারিনি। আড় চোখে লক্ষ্য করেছিলাম তোমার ভিতরকার কষ্টটা। বড়দের মুখের ওপর সব সময় কথা বলা যায় না ঠিকটা জেনেও। তখন অনুভব করতে পারি যন্ত্রণাটা, যেটা আমি অনেক বছর ধরে পেয়ে চলেছি। যে পাখিটা শিকলে বাঁধা থাকে সেও যে উড়তে পারে সেটাই সে ভুলে যায়। আজ যখন শিকল কাটাতে পেরেছি তখন এক আকাশ স্বাধীনতাও পেয়েছি। তাছাড়া আমি নিজে সায়েন্স পড়েছি। তাই এই যুক্তি কি করে মানব? যার সাথে সারা জীবন থাকব তার পছন্দটাকে মূল্য দিতে না পারলে তার থেকে ভালোবাসাটাও আদায় করব কীভাবে? আমাদের বিয়েটা তো প্রেম করে নয়। দেখাশোনা করেই। তাই জীবনের শুরুটা কোনো অপছন্দ দিয়ে হোক এটা আমি চাই না। আর এই পালঙ্কটা আমারও বেশ পছন্দ। এটা একটা ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হয়। তাই আজকের দিনে একে অপরকে ভালোবাসার আনন্দে মেতে উঠি বরং। প্রেমটা শুরুই হোক আজ থেকেই।
এমন কথাতেই বিক্রমের মনের আকাশটা জয় করে নেয় পৌলমী। বিক্রম বলে,
-জানো পৌলমী এই পালঙ্কটা আমার সত্যিকারের ভীষণ প্রিয়। আমি ছোটো বেলায় আমার দাদু ঠাকুমার কাছে ঘুমোতাম। ঠাকুমা কত গল্প বলতো। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে থাকত এক রাজ কন্যা। ঠাকুমা সেই রাজকন্যার গল্প বলতো। আমি মনে মনে সেই রাজকন্যাকে ভাবতাম। চোখ বন্ধ করলে সেই রাজকন্যা আসত। আর আজও সেই রূপকথার রাজ কন্যাকে দেখছি পৌলমী।তবে চোখ বন্ধ করে নয়,চোখ খুলেই। আমার সামনে,আমার মনে মননে তুমি শুধু সেই রূপকথার রাজকন্যা পৌলমী। অনেক অনেক ভালোবেসে ফেললাম আজ।
যাইহোক সে সব কথা, মায়ের ফোন পেয়ে ভরা আসরের আড্ডা থেকে সরে এসে পৌলমী ফোনটা রিসিভ করেই বলে,
-হ্যাঁ মা বলো।
-তোর মতো মেয়ে এই জঘন্য কাজটা মেনে নিল কী করে এটা ভেবেই তো অবাক হচ্ছি। আমি সত্যিই ভাবতে পারছি না যে আমার মেয়ে হয়ে তুইও আমার কথা অমান্য করলি?
-আর কিছু বলবে মা! এখন এসব কথা বলার সময় নয়। বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। আমি সবার সাথেই ছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে উঠে এসেছি। তাই বেশি কথা বলতে পারব না। আমাকে সবাই খারাপ ভাবতে পারে। আর কাল সকালে সবাই চলেও যাবে। তাই এই সময়টুকু ওদের সাথে কাটাই।
-তোর মায়ের খারাপ লাগাটার কথা এক বারও ভাবলি না? মা'কে ছোটো করে দিলি? এখন ওদের খারাপ লাগার কথা ভাবছিস। আজ ওরা তোর আপন হয়ে গেল? তোর এসব বলতে লজ্জা করে না?
-আমি তো ভুল কিছু করিনি মা। যেটা ঠিক মনে হয়েছে সেটাই করেছি।
-মায়ের মুখের ওপর কথা বলছিস? তা কার বুদ্ধিতে ওই পালঙ্কটাই রয়ে গেল ঘরে?
-আমি নিজেই বলেছি মা। বিক্রম বলেছিল ঘর থেকে বের করে দেবে। আমি রাজি হইনি। ওই পালঙ্কটা বিক্রমের খুব প্রিয়। পালঙ্কটার সাথে ওর আবেগ ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। কাছের মানুষের পছন্দটাকে সম্মান দেওয়াটাই শিক্ষা।আমি যেটা করেছি সেটা আমার শিক্ষা থেকেই করেছি।
--এটা তোর শিক্ষা নয়। আধুনিক হতে শেখ।নিজেকে আপডেট কর।
-ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরাটা তোমার কাছে যদি বেমানান হয় তাহলে ওটাই আমার কাছে আধুনিকতা।
-আমার ভাবতে লজ্জা লাগছে দুটো দিন মাত্র বিয়ে হয়েছে তাতেই তোর এতটা বদল? একবারেই আলাদা লাগছে তোকে!
-আমি তো আলাদাই ছিলাম মা। কবে আমাকে সময় দিয়েছো। শুধু নিজেদের মতো করে চালিয়েছো। আমার মতামতকে কখনো প্রাধান্য দাওনি। আমাকে যন্ত্রে পরিণত করেছো। আমাকে আমার মতো করেই সংসারটা করতে দাও । তবে একটা কথা সত্যি মা আজ নিজেকে মুক্ত করেছি বলেই তোমাদের আভিজাত্যের বক্স খাটকে দূরে সরিয়ে কারো ভালোবাসার পালঙ্ককে সম্মান দিয়েছি। যদি এতে মনে হয় আমি দোষ করেছি, তাহলে আশীর্বাদ করো এই দোষ যেন সারা জীবন করতে পারি। এখন রাখি মা। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ভালো থেকো।
••••••••••••••••••××ו••••••••••••••••••