কলিগ্রামের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে শ্যাওলা ধরা, প্রাচীন একটি কবরস্থান। দিনের আলোতেও সেখানে এক ধরনের থমথমে নীরবতা বিরাজ করে। স্থানীয়রা বলত, রাতের বেলা কবরস্থানের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ফিসফিসানি আর চাপা কান্নার শব্দ শোনা যায়। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে সেই কবরস্থানের বহু গল্প প্রচলিত ছিল, কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় ছিল একটি নির্দিষ্ট কবরের কথা। সেই কবরের কোনো নামফলক ছিল না, ছিল শুধু একটি সাদা ফুলের গাছ। কেউ জানে না কোথা থেকে সেই ফুল এসেছে, শুধু জানে বছরের পর বছর সেই ফুল ফুটে থাকে। এই কবরটি ছিল লতিকার, যে মাত্র বাইশ বছর বয়সে খুন হয়েছিল।
লতিকা ছিল কলিগ্রামের সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে। তার লম্বা কালো চুলের বিনুনি, কাজল কালো চোখ আর মুক্তোর মতো হাসি যেকোনো পুরুষের মন জয় করার জন্য যথেষ্ট ছিল। গ্রামের জমিদার রুদ্র চৌধুরীর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল তার উপর। রুদ্র ছিল উদ্ধত ও অহংকারী। তার মনে হয়েছিল, কলিগ্রামের কোনো মেয়ের সাধ্য নেই তার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করার। কিন্তু লতিকা ছিল ব্যতিক্রম। সে রুদ্রকে ভালোবাসেনি, বরং তার অহংকার আর নিষ্ঠুরতাকে ঘৃণা করত। রুদ্র যখন তার ভালোবাসা প্রকাশ করে, লতিকা দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে। রুদ্রের অহংকারে আঘাত লাগে। তার মনে হয়, লতিকা তাকে অপমান করেছে। এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে অধীর হয়ে ওঠে।
এক অমাবস্যার রাতে, যখন গ্রামের সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন, রুদ্র তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে লতিকার বাড়িতে আসে। লতিকার বাবা-মা ছিলেন বৃদ্ধ ও দুর্বল। তারা রুদ্রের সামনে অসহায় ছিলেন। রুদ্র লতিকাকে অপহরণ করে এবং তাকে গ্রামের বাইরে নিয়ে যায়। সেই রাতের অন্ধকার ভেদ করে লতিকার চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। পরদিন সকালে এক রাখাল লতিকার নিথর দেহ দেখতে পায় গ্রামের পাশের এক নির্জন নদীর ধারে। লতিকাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল। তার গায়ে ছিল অত্যাচারের চিহ্ন, যা দেখে গ্রামের সবাই বুঝেছিল এটি কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়। কিন্তু রুদ্র চৌধুরীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। লতিকার বাবা-মা বিচার চেয়েছিলেন, কিন্তু রুদ্রের ক্ষমতার কাছে তাদের কান্না চাপা পড়ে যায়। লতিকাকে তার নিজের হাতেই তৈরি করা কবরে সমাহিত করা হয়, যেখানে কোনো নামফলক ছিল না, কেবল একটি সাদা ফুল ফুটে ওঠে।
লতিকার মৃত্যুর পর থেকেই কলিগ্রামে অশুভ ঘটনার শুরু হয়। রাতের বেলায় মানুষ প্রায়ই দেখতে পেত, লতিকার কবর থেকে একটা হালকা নীল আলো বের হয়ে আসে। সেই আলো ধীরে ধীরে এক অস্পষ্ট নারীর আকৃতি ধারণ করত। সেই আকৃতিটি ছিল ঠিক লতিকার মতো, কিন্তু তার চোখ দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো লাল ছিল। গ্রামবাসী সেই ভূতকে "কবরের ভূত" নাম দিয়েছিল। রাতে গ্রামের রাস্তাগুলো নির্জন হয়ে যেত। কোনো সাহসী ব্যক্তিও লতিকার কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সাহস পেত না।
গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে অর্জুন, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক যুবক, এই সব ভূতের গল্পকে নিছকই কুসংস্কার মনে করত। সে ছিল খুবই যুক্তিবাদী এবং সাহসী। তার বন্ধুদের সামনে প্রায়ই সে এই সব গল্পকে হাসির ছলে উড়িয়ে দিত। একদিন অর্জুন তার তিন বন্ধুকে নিয়ে বাজি ধরে যে, তারা রাতের বেলায় কবরস্থানে যাবে। অর্জুনের তিন বন্ধু, সায়ন, রাহুল আর বিক্রম, প্রথমে ভয় পেলেও অর্জুনের জেদের কাছে হার মানে। তারা ঠিক করে অমাবস্যার রাতে তারা কবরস্থানে যাবে, কারণ গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, এই রাতে ভূতের কার্যকলাপ সবচেয়ে বেশি হয়।
অমাবস্যার রাতে, যখন চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন, চাঁদের আলোও নেই, তখন চার বন্ধু কবরস্থানে পৌঁছায়। তাদের হাতে ছিল টর্চলাইট, যা দিয়ে তারা কবরের উপর আলো ফেলে। চারদিকে গাছের শুকনো পাতার মচমচ শব্দ, ঝিঁঝিপোকার ডাক আর সেই থমথমে নীরবতা, যা ভয়কে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বিক্রম তো ভয়ে কাঁপছিল, রাহুল বারবার অর্জুনকে ফিরে যাওয়ার কথা বলছিল। কিন্তু অর্জুন তার জেদ ধরে লতিকার কবরের দিকে এগিয়ে গেল। যখন তারা কবরের কাছে পৌঁছল, তখন তাদের সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। লতিকার কবরের উপর থেকে এক হিমশীতল বাতাস তাদের দিকে ছুটে এলো। অর্জুনের টর্চলাইটের আলোতে তারা দেখল, লতিকার কবরের মাটি থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সেই রক্ত মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ করেই তাদের সামনে লতিকার অশরীরী আত্মা আবির্ভূত হলো। তার দেহ হালকা নীল আলোয় ঢাকা, চুলগুলো এলোমেলো, আর জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টিতে ছিল গভীর বেদনা। আত্মাটি তাদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে উঠল, "তোমরা কেন এসেছ? আমার কি শান্তি নেই? আমার হত্যাকারীকে তোমরা কি দেখেছ?" অর্জুন ভয়ে জমে গিয়েছিল, কিন্তু তার যুক্তিবাদী মন তাকে সাহসের যোগান দিচ্ছিল। সে কোনোমতে বলে উঠল, "আমরা তোমায় ভয় দেখাতে আসিনি। আমরা শুধু জানতে চাই, কে তোমার এই হাল করেছে?" আত্মাটি তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল, তার চোখ থেকে যেন রক্ত ঝরে পড়ছিল। সে তার করুণ কাহিনী বলতে শুরু করল।
আত্মাটি বলল, রুদ্র চৌধুরী তাকে কীভাবে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল। তার আত্মা আজও মুক্তি পায়নি, কারণ তার খুনি এখনো শাস্তি পায়নি। লতিকার আত্মা রুদ্রের উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। তার কথাগুলো শুনে অর্জুন আর তার বন্ধুরা বুঝতে পারল যে, লতিকার ভূত কোনো ক্ষতি করার জন্য আসেনি, এসেছে শুধু সুবিচার চাওয়ার জন্য। তারা যখন লতিকার কবর থেকে বের হয়ে আসছিল, তখন রাহুল দেখতে পেল, সেই সাদা ফুল গাছটি মরে যাচ্ছে, ফুলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। রাহুল বলল, "যতদিন লতিকা সুবিচার না পাবে, ততদিন এই ফুলও বাঁচবে না।"
পরদিন সকালে অর্জুন তার বাবাকে সব ঘটনা খুলে বলল। পঞ্চায়েত প্রধান প্রথমে এসব বিশ্বাস করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু অর্জুনের চোখের ভয় আর তার যুক্তিতে তিনি ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তারা রুদ্র চৌধুরীকে ডেকে পাঠালেন। রুদ্র চৌধুরী বরাবরের মতোই সব অস্বীকার করলেন। তখন অর্জুন তাকে লতিকার কবরের পাশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। রুদ্র প্রথমে যেতে রাজি ছিল না, কিন্তু গ্রামের সবার চাপে তাকে যেতে হলো।
তারা যখন লতিকার কবরের কাছে পৌঁছায়, তখন লতিকার আত্মা সেখানে হাজির হলো। এইবার তার চেহারা আরও ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। সে সরাসরি রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, "রুদ্র, তুই আমার জীবন কেড়ে নিয়েছিস, কিন্তু আমার আত্মা তোর শান্তি কেড়ে নেবে।" রুদ্র ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তার পা জড়িয়ে ধরল। রুদ্র কোনোমতে বলতে লাগল, "আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি ভুল করেছি।" কিন্তু লতিকার আত্মা তার কথা শুনল না। সে রুদ্রকে আক্রমণ করল। রুদ্র চিৎকার করতে লাগল। তার চিৎকারে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। লতিকার আত্মা রুদ্রকে একটি দীর্ঘ যন্ত্রণা দেয়, যা তাকে তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত করে। এরপর লতিকার আত্মা রুদ্রকে ছেড়ে দেয়। রুদ্র অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার শরীর জ্বরে পুড়ছিল। তার চোখ দুটো লাল হয়ে গিয়েছিল, যেন সে এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছিল।
রুদ্র তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল। সে সবার সামনে তার অপরাধ স্বীকার করল এবং লতিকার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইল। লতিকার পরিবার রুদ্রকে ক্ষমা করে দিল। গ্রামের সবাই বুঝতে পারল যে, লতিকার আত্মা শুধু প্রতিশোধ চায়নি, চেয়েছিল তার অপরাধীর স্বীকারোক্তি এবং অনুতাপ। রুদ্রকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হলো। রুদ্রের শাস্তি পাওয়ার পর লতিকার কবরের সাদা ফুল আবার সতেজ হয়ে ফুটে উঠল। লতিকার আত্মা আর কখনো গ্রামের কারো কাছে দেখা দেয়নি। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, লতিকার আত্মা এখন শান্তিতে আছে। কিন্তু সেই অমাবস্যার রাতের ভয়, কবরের পাশে লতিকার ফিসফিসানি, আর রুদ্রের অপরাধের স্বীকারোক্তি—সবই কলিগ্রামের মানুষের মনে গভীর দাগ কেটে রেখেছিল। সেই থেকে গ্রামের সবাই জেনেছিল, কিছু আত্মা শুধু প্রতিশোধ চায় না, তারা চায় সুবিচার।
( গল্পটি পড়ে কেমন লাগলো অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন, আপনারা যারা এখনও আমাকে অনুসরণ করেনি তারা দ্রুত অনুসরণ করুন যাতে নতুন নতুন কোনো লেখা আসলে আপনারা নোটিফিকেশন এর মাধ্যমে জানতে পারেন , গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। )
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder