শেষ চিঠি
- অভিজিৎ হালদার
শীতের সন্ধ্যা। কুয়াশা যেন হিমবাহের চাঁদর হয়ে চারদিক ঢেকে রেখেছে। কলকাতা শহরের ব্যস্ততা পেরিয়ে দক্ষিণের এক পুরনো গ্রাম — হরিনাভি। গ্রাম নয় এখন, আধা শহর বলা চলে। কিন্তু গ্রামে একটা পুরনো বাগানবাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে, যেন সময়ের কাছে হার মানতে রাজি নয়। নাম নন্দনকানন ভিলা। এককালে জমিদারের বসবাস ছিল, এখন পরিত্যক্ত। গ্রামের মানুষ বলে, ওই বাড়িতে কিছু আছে… কিছু অদ্ভুত। রাতে আলো জ্বলে, জানালা খুলে হাওয়ায় দুলে ওঠে পর্দা — অথচ কেউ থাকে না।
তবে একদিন সাহস করে ঢুকে পড়ে অনিকেত — শহরের তরুণ লেখক। ভূতের গল্প লেখে, কিন্তু নিজের জীবনে কখনও ভূতের ছায়াও দেখেনি। তাই এই বাগানবাড়ি নিয়ে লিখতে এসেই সিদ্ধান্ত নেয় — এক রাত থাকবে এখানেই।
…................................................
( ভালো লাগলে অবশ্যই আমাকে অনুসরণ করুন, পাশে থাকুন এবং সাপোর্ট করুন ও মূল্যবান মন্তব্য করুন , ধন্যবাদ )
.....................................................
বাড়িটা বেশ পুরনো, দরজাগুলোর গায়ে মরিচা লেগেছে। অনিকেত হাতে টর্চ জ্বালিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে। ধুলোয় ভরা মেঝে, দেয়ালে ছোপ ছোপ ছাঁচ। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস — মাঝের ঘরে একটি পুরনো ডেস্ক, তার ওপর রাখা একটি খোলা চিঠি। কালি ফ্যাকাশে হলেও লেখা এখনও পড়া যায়।
চিঠিটা যেন সময়ের ফাঁক থেকে উঠে এসেছে —
“প্রিয় মেঘলা,
তুমি যে ফিরে আসনি, তার দুঃখ আমাকে প্রতিদিন খেয়ে ফেলে। কিন্তু আমি এখনও অপেক্ষা করি… ঠিক যেমন প্রতিদিন সন্ধ্যায় জানালার পাশে বসে থাকি। জানি, তুমি আসবে… কোনো একদিন।
— অরিন্দম”
অনিকেত চিঠিটা হাতে নিয়ে ভাবে — কে এই অরিন্দম? কে মেঘলা? এই চিঠির মধ্যেই লুকিয়ে আছে কোনো রহস্য?
[© Copyright Reserved •• Abhijit Halder]
রাত গড়িয়ে যায়। অনিকেত ডেস্কে বসে লিখতে থাকে। হঠাৎ বাইরের জানালা ঠাস করে বন্ধ হয়ে যায় — অথচ সে জানালাই তো বন্ধ ছিল! বাতাসও নেই। টর্চ নিভে যায়। অন্ধকারে চোখ সয় না, তখনই শুনতে পায় এক নিঃশ্বাসের শব্দ… যেন কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে।
সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় — কেউ নেই।
কিন্তু ডেস্কে রাখা চিঠিটা নেই!
তার বদলে রাখা নতুন একটা চিঠি। তাতে লেখা---
“তুমি কি আমার চিঠি পড়লে? আমি এখনও অপেক্ষা করছি মেঘলার জন্য। যদি তুমি তাকে খুঁজে দিতে পারো… আমি মুক্তি পাই।
—অনিকেত অবাক। এটা কি কেউ মজা করছে? না কি… সত্যিই কিছু আছে এখানে?
পরদিন সকালে, সে হরিনাভির স্থানীয় লাইব্রেরিতে খোঁজ করতে যায়। লাইব্রেরির এক বৃদ্ধ কর্মচারী মণিকান্ত বাবু তার কৌতূহলে উৎসাহী হয়ে বলে —
“অরিন্দম বসু? হ্যাঁ… সে এই বাড়িরই ছেলে ছিল। জমিদার পরিবারের শেষ সন্তান। বিশ বছর বয়সে প্রেমে পড়েছিল এক মেয়ের — মেঘলা সেন। কিন্তু সেই প্রেম সমাজ মেনে নেয়নি। মেঘলা ছিল চাকরের মেয়ে।”
“তারপর?” — জিজ্ঞেস করে অনিকেত।
“মেঘলা একদিন চিঠি দিয়ে পালিয়ে যায়… বলে, সে আর ফিরে আসবে না। কিন্তু পরে কেউ বলে, সে আসার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রাস্তায় মারা যায় দুর্ঘটনায়। আর অরিন্দম… প্রতিদিন জানালার পাশে বসে থাকত, চিঠি লিখত, মেঘলার জন্য। একদিন সেই জানালার পাশেই নিঃশ্বাস ত্যাগ করে — মনে হয়েছিল হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু কেউ কেউ বলে, সে নিজের প্রাণ দিয়েছিল।”
অনিকেতের গায়ে কাঁটা দেয়। সে বুঝতে পারে, এই বাড়িতে কিছু আছে… কিছু অসমাপ্ত ভালোবাসা।
.....................................
( গল্পটি পড়ে কেমন লাগছে জানাবেন , আপনারা পাশে থাকবেন এবং আমাকে অনুসরণ করে রাখবেন, ধন্যবাদ )
....................................
সন্ধ্যায় সে আবার যায় নন্দনকানন ভিলায়। এবার সে ডেস্কে চিঠি রাখে নিজেই —
“অরিন্দম, আমি তোমার গল্প জানি। তুমি কি অপেক্ষা করছো এখনও?”
রাত গভীর হলে, আবার হাওয়ায় খসে পড়ে জানালার পর্দা। এক শীতল বাতাস ঘরে ঢোকে। দরজা খোলে আপনিই। তখনি ডেস্কে আরেকটি চিঠি দেখা যায়।
“তুমি যদি সত্যি জানতে চাও — তবে আমাকে খুঁজে নাও সেই পুরনো কুয়োর পাশে, যেখানে মেঘলার চুলের ফিতে পড়ে ছিল… সেদিন।”
অনিকেত দৌড়ে যায় বাড়ির পেছনে, পুরনো কুয়োর পাশে — যা অনেক আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে আলো ফেলতেই দেখে — কুয়োর দেয়ালে খোদাই করা নাম ---মেঘলা।
সে ঠিক করে, সকালে পুরনো নথি ঘেঁটে দেখবে কুয়োর সত্যি ইতিহাস। সকালে মণিকান্ত বাবুর কাছ থেকে জানতে পারে —
“হ্যাঁ, মেঘলার দেহ ওই কুয়োর পাশেই পাওয়া গিয়েছিল। সে ফিরছিল, কিন্তু কেউ যেন… তাকে পৌঁছাতে দেয়নি। পুলিশ সন্দেহ করেছিল, জমিদারদের কেউ সেটা হতে পারে।”
অনিকেত এবার ঠিক করে — সে এই কাহিনি শেষ করবে। লেখক হিসেবে নয় — একজন মানুষ হিসেবে। সে রাতে আবার যায় সেই বাড়িতে, আর ডেস্কে শেষ চিঠিটা রাখে —
“অরিন্দম, মেঘলা এসেছিল। সমাজ তাকে আসতে দেয়নি। কিন্তু সে তোমাকে ভালোবাসত। আমি এই কথাটা তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম। তুমি এবার শান্তিতে যেতে পারো।”
রাত প্রায় তিনটে। হঠাৎ জানালা খুলে যায়। বাইরে নরম কুয়াশার মধ্যে দুইটি ছায়া দেখা যায় — এক পুরুষ, এক নারী। তারা হাত ধরাধরি করে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কুয়াশার গভীরে।
ডেস্কে পড়ে থাকে একটি শেষ চিঠি —
“ধন্যবাদ, অচেনা বন্ধু। এখন আমরা একসাথে আছি… অবশেষে।”
অনেক বছর পর, অনিকেতের লেখা বই — শেষ চিঠি — আলোড়ন তোলে। গল্প নয়, বাস্তবের ছোঁয়া লেগে থাকা এই ভূতের গল্প পাঠককে কাঁদায়। কেউ কেউ বিশ্বাস করে, সত্যিই এমন ভালোবাসা আজও ঘোরে বাতাসে।
আর নন্দনকানন ভিলা? এখনো দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আর কো
নো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে না। জানালার পাশে রাখা থাকে একটি খালি ডেস্ক… আর একটি গুল্মফুল — মেঘলার প্রিয় ফুল।