নির্জন মহলের অভিশাপ
- অভিজিৎ হালদার ••••
লরেনজো ছিল এক দুঃসাহসী তরুণ, যার রক্তে মিশে ছিল অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। ইতালির প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক প্রাচীন, পরিত্যক্ত মহলের গল্প তাকে প্রবলভাবে টানছিল। কথিত আছে, সেই মহলের শেষ মালিক, এক অদ্ভুতুড়ে শিল্পী, মারা যাওয়ার পর থেকেই তার আত্মা মহলের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে আসা ফিসফাস, মহলের প্রতি এক ভীতি ও কৌতূহলের মিশেল লরেনজোর মনে এক গভীর আকর্ষণ তৈরি করেছিল। লরেনজোর বন্ধু মার্কো তাকে বারবার সতর্ক করেছিল, 'লরেনজো, পুরনো জিনিসের সঙ্গে ঘাঁটাঘাটি করা ভালো নয়। বিশেষ করে যখন এর সাথে অতৃপ্ত আত্মার গল্প জড়িয়ে থাকে।' কিন্তু লরেনজো অবিচল। এক নির্জন দুপুরে, রোদ যখন কমলা আভায় রাঙা, লরেনজো তার মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেই অভিশপ্ত মহলের উদ্দেশ্যে। মনে তার উত্তেজনা আর এক ফোঁটা অজানা ভয়, যা অ্যাডভেঞ্চারের প্রতিটি ধাপকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে।
মহলের কাছে পৌঁছাতেই লরেনজো থমকে গেল। দীর্ঘদিনের অযত্নে মহলটি যেন প্রকৃতির কোলে মিশে গেছে। প্রবেশপথের বিশাল লোহার গেটে মোটা মরচে ধরেছে, আর তার চারপাশে জন্মানো আগাছা তাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে। গেটের ওপরের কারুকার্যময় নকশাগুলো অতীতের রাজকীয়তার সাক্ষ্য বহন করছিল, কিন্তু এখন তা কেবলই বিস্মৃত গল্পের অংশ। চারপাশে কোনো জনমানব নেই, শুধু বাতাসের শনশন শব্দ আর ঝিঁঝিঁর একটানা ডাক। লরেনজো গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরের আঙিনায় উঁচু গাছের সারি, যাদের শাখা-প্রশাখা যেন মহলের পাহারাদার। সবুজের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে অট্টালিকার বিশালতা, যার ইট-পাথরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অজানা রহস্য। লরেনজো ধীরে ধীরে মূল দরজার দিকে এগিয়ে চলল। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন প্রাচীন স্থাপত্যের নিস্তব্ধতা ভাঙছিল, আর এক অদেখা শক্তির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল।
মহলের প্রধান দরজা ছিল খোলা, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি লরেনজোকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। ভেতরের পরিবেশ ছিল এক অন্য জগৎ। বিশাল হলঘরে ধুলোর আস্তরণ, আর প্রাচীন আসবাবপত্রগুলো অযত্নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সূর্যের আলো জানালার ভাঙা কাঁচ ভেদ করে হলঘরের মেঝেতে অদ্ভুত নকশা তৈরি করেছে। বাতাসে কেমন যেন একটা পুরোনো গন্ধ, যা শত শত বছরের জমে থাকা স্মৃতি আর নিঃশ্বাসের ভারে ভারী। লরেনজো সাবধানে পা ফেলল। প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝে থেকে এক পুরোনো ক্রিক শব্দ ভেসে আসছিল, যা মহলের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছিল। দেয়ালের তেলচিত্রগুলো ছিল কালচে হয়ে যাওয়া, কিন্তু তাদের মধ্যে তখনও এক ধরনের গম্ভীর সৌন্দর্য লুকিয়ে ছিল। লরেনজো বুঝতে পারল, এই মহল কেবল একটি পরিত্যক্ত কাঠামো নয়, এটি যেন এক জীবন্ত ইতিহাস, যা তার নিজস্ব গল্প বলতে প্রস্তুত।
লরেনজো হলঘর পেরিয়ে একটি লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে শুরু করল। করিডোরের দু'পাশে সারি সারি বন্ধ দরজা। প্রতিটি দরজার গায়ে খোদাই করা নকশাগুলো যেন নীরব ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। হঠাৎ, লরেনজোর কানে এক মৃদু ফিসফাস ভেসে এল। যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে, কিন্তু এতটাই ক্ষীণ যে প্রায় শোনা যাচ্ছে না। লরেনজো থমকে দাঁড়াল। চারপাশ নিস্তব্ধ। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, হয়তো বাতাসের শব্দ বা তার মনের ভুল। কিন্তু ফিসফাসটা আবারও শোনা গেল, এবার আরও স্পষ্ট। লরেনজো বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, সে এই মহলে একা নয়। অদৃশ্য কোনো শক্তি তার চারপাশে বিদ্যমান, যা তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে।
তার চোখে পড়ল একটি প্রাচীন আয়না। আয়নাটি দেয়ালের সাথে এমনভাবে লাগানো ছিল যেন কেউ এটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে রেখে গেছে। লরেনজো আয়নার কাছে যেতেই তার চোখ আটকে গেল। আয়নার ভেতর তার প্রতিচ্ছবি ছাড়াও যেন আরও কিছু একটা ছিল। এক অস্পষ্ট, ধূসর আকৃতি, যা মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল এবং মিলিয়ে গেল। লরেনজো বুক কেঁপে উঠল। এটা কি তার মনের ভুল, নাকি সত্যিই সে কিছু দেখল? সে মুহূর্তের জন্য চোখ কচলে আবার আয়নার দিকে তাকাল। এবার আর কিছু নেই। লরেনজো নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, হয়তো আলোর প্রতিসরণ বা ধুলোর কারণে এমনটা মনে হয়েছে। কিন্তু তার মনের গভীরে এক অজানা ভয় কাজ করছিল, যা তাকে অস্থির করে তুলছিল।
লরেনজো মহলের দোতলায় উঠল। সেখানকার পরিবেশ আরও বেশি গুমোট। করিডোরের শেষ প্রান্তে একটি ভারী কাঠের দরজা। দরজাটির ওপর অদ্ভুত নকশা খোদাই করা, যা অন্য কোনো দরজায় ছিল না। লরেনজোর মনে হলো, এই কক্ষটি মহলের বাকি অংশ থেকে আলাদা। কৌতূহল তাকে ঠেলে নিয়ে গেল দরজার দিকে। সে আলতো করে দরজায় হাত দিল। দরজাটি সামান্য ফাঁক হতেই এক শীতল বাতাস তার গায়ে এসে লাগল। ভেতরের দৃশ্য ছিল আরও রহস্যময়। একটি বিশাল স্টুডিও, যেখানে শিল্পী নাকি তার শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। মাঝখানে একটি ইজেল, তার ওপর একটি অসম্পূর্ণ ছবি। রং আর তুলিগুলো তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেন শিল্পী মাত্র কাজ শেষ করে উঠে গেছেন। লরেনজো সাবধানে কক্ষের ভেতরে ঢুকল। এই কক্ষটি যেন মহলের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে অতীতের গভীরতম রহস্যগুলো লুকিয়ে আছে।
স্টুডিওতে প্রবেশ করে লরেনজো মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখতে লাগল। দেয়ালজুড়ে অসংখ্য স্কেচ আর অসম্পূর্ণ চিত্রকর্ম। প্রতিটি ছবিতে যেন শিল্পীর জীবনের কোনো অংশ ধরা আছে। এক কোণে একটি ছোট টেবিলের ওপর কিছু পুরনো বই, ভাঙা কলম আর একটি অদ্ভুত নকশার ঘড়ি। ঘড়িটি ছিল প্রাচীন, তার ওপরের কাঁচ ভাঙা, আর কাঁটাগুলো স্থির হয়ে আছে। লরেনজো ঘড়িটির দিকে হাত বাড়াল। ঘড়িটি হাতে নিতেই তার মনে হলো যেন ঘড়ির ভেতর থেকে এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আকর্ষণ করছে। সে ঘড়িটি ঘুরিয়ে দেখল। তার মনে প্রশ্ন জাগল, এই ঘড়িটি কি সত্যিই নির্জীব, নাকি এর ভেতরেও কোনো অতৃপ্ত আত্মার অস্তিত্ব বিদ্যমান?
ঘড়িটি হাতে নিয়ে লরেনজো তার সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। সে সেটিকে ভালোভাবে দেখতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার হাত থেকে পড়ে গেল। মেঝেতে পড়ে ঘড়িটি আরও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মুহূর্তেই ঘরের তাপমাত্রা যেন কয়েক ডিগ্রি কমে গেল। চারপাশে এক চাপা নিস্তব্ধতা নেমে এল, যা ছিল আগের চেয়েও ভয়ংকর। লরেনজোর মনে হলো, কেউ যেন তাকে দেখছে। সে দ্রুত পেছনে ফিরল। ঘরের কোণায়, যেখানে শিল্পী কাজ করতেন, সেখানে এক অস্পষ্ট কালো আকৃতি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। আকৃতিটি যেন এক বৃদ্ধ মানুষের, তার চোখ দুটো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। লরেনজোর গা ছমছম করে উঠল। সে বুঝতে পারল, সে এক মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে, এমন ভুল যার জন্য তাকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
আকৃতিটি আরও স্পষ্ট হতে শুরু করল। এটি যেন মহলের পূর্বতন মালিকের ছায়া। এক শীতল, গম্ভীর কণ্ঠস্বর লরেনজোর কানে ভেসে এল, 'তুমি আমার জিনিস নষ্ট করেছ! এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।' লরেনজো ভয়ে জমে গেল। সে পালাতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন মাটির সঙ্গে সেঁটে গেছে। অদৃশ্য এক শক্তি তাকে ধাক্কা দিল, লরেনজো মেঝেতে পড়ে গেল। এরপর একের পর এক ঘরের আসবাবপত্র তার দিকে ধেয়ে আসতে লাগল। চেয়ার, টেবিল, বইয়ের আলমারি – যেন অদৃশ্য কোনো হাত সেগুলো ছুড়ে মারছে। লরেনজো কোনোমতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল। সে বুঝতে পারল, মহলের মালিকের আত্মা তার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ঘরের চারপাশের রং এবং তুলিগুলো যেন আপনা আপনি উড়ছিল এবং লরেনজোকে ঘিরে ধরছিল। এক ভয়ংকর বিশৃঙ্খলার মধ্যে লরেনজো জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল।
লরেনজোর চারপাশে আসবাবপত্রগুলো এলোমেলোভাবে উড়তে লাগল, আর সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। কক্ষের ভেতরটা যেন এক উন্মাদ নৃত্যে মেতে উঠেছে। স্কেচগুলো দেয়াল থেকে খসে পড়ছিল, তাদের ভেতর থেকে আঁকা মুখগুলো যেন লরেনজোর দিকে হিংস্রভাবে তাকিয়ে ছিল। বাতাসের চাপ এতটাই বেড়ে গেল যে লরেনজোর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সে অনুভব করল, অদৃশ্য কোনো হাত তার গলা টিপে ধরছে। সে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। মহলের মালিকের ক্রোধ যেন সমস্ত কক্ষকে গ্রাস করে ফেলেছে, আর লরেনজো সেই ক্রোধের শিকার। তার মনে হলো, এটাই তার শেষ সময়, এই মহলের ভেতরই তার জীবন শেষ হতে চলেছে।
কোনোমতে লরেনজো নিজেকে অদৃশ্য হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিল। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল এবং স্টুডিওর দরজার দিকে দৌড়াতে শুরু করল। তার পেছনে যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাড়া করছে। সে প্রতিটি সিঁড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল, তার হৃদপিণ্ড যেন দ্রুত তালে বাজছিল। মহলের নিস্তব্ধতা ভেঙে গিয়েছিল তার নিজের পায়ের শব্দে। সে মূল দরজার দিকে ছুটল। কিন্তু পথ যেন শেষ হচ্ছিল না। করিডোরের দেয়ালের ছবিগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল, আর আয়নার প্রতিচ্ছবিতে সে দেখছিল নিজের ভয়ার্ত মুখ। সে বুঝতে পারছিল, এই মহল তাকে সহজে ছেড়ে দেবে না। প্রতিটি পদক্ষেপে সে অনুভব করছিল আত্মার শীতল শ্বাস, যা তার ঘাড়ে এসে পড়ছিল। পলায়নের এই মরিয়া চেষ্টা তাকে আরও ক্লান্ত করে তুলছিল, কিন্তু বাঁচতে হলে তাকে দৌড়াতেই হবে।
যখন লরেনজো হলঘরের দিকে ছুটছিল, হঠাৎ মহলের প্রধান দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। লরেনজো থমকে দাঁড়াল। তার হৃদপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল। সে দরজা খুলতে চাইল, কিন্তু লোহার গেটটি যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে প্রাণপণে গেট ধাক্কাতে লাগল, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মহলের ভেতর থেকে এক বিকট শব্দ ভেসে এল, যেন মহলটি নিজেই শ্বাস নিচ্ছে। লরেনজো বুঝতে পারল, সে এই মহলে আটকা পড়েছে। বাইরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ। তার চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। সে হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়ল, তার চারপাশে কেবল মহলের গুমোট নিস্তব্ধতা আর তার নিজের দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস।
লরেনজো যখন নিরাশার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল, তখন সে দেখল হলঘরের এক কোণে একটি মূর্তির ছায়া যেন ধীরে ধীরে দীর্ঘ হচ্ছে। ছায়াটি এক বৃদ্ধ মানুষের আকৃতি ধারণ করল, তার হাতে একটি কুড়াল। লরেনজো ভয়ে কুঁকড়ে গেল। এটি কি কেবলই একটি ছায়া, নাকি মহলের মালিকের আত্মা তার সামনে মূর্তিমান হয়েছে? ছায়াটি ধীরে ধীরে লরেনজোর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, আর তার প্রতিটি পদক্ষেপে মেঝে থেকে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছিল। লরেনজো নিজেকে সরাতে পারছিল না। সে জানত না কী করবে, কোথায় যাবে। তার মনে হচ্ছিল, তার জীবনের শেষ মুহূর্ত আসন্ন। এই মহলের প্রতিটি দেয়াল যেন তাকে গ্রাস করতে চাইছে।
ছায়াটি লরেনজোর একদম কাছে চলে এল। তার চোখে যেন এক অমানুষিক ক্রোধ জ্বলছিল। লরেনজোর মনে হলো, এই আত্মা কেবল প্রতিশোধ চায় না, সে চায় তাকে কষ্ট দিতে। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করল। হঠাৎ, তার মনে এক অদ্ভুত ভাবনা এল। শিল্পী কি কেবলই এক প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মা, নাকি তার পেছনে কোনো গল্প আছে? লরেনজো সাহস করে চোখ খুলল এবং ছায়ার দিকে তাকাল। 'আপনি কেন এমন করছেন?' লরেনজো দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল। ছায়াটি থমকে গেল। তার চোখে ক্রোধের পাশাপাশি এক অদ্ভুত বিষাদ দেখা গেল, যেন সে তার অতীতে ফিরে গেছে। লরেনজো বুঝতে পারল, এই আত্মা কেবল একটি ভূতের চেয়েও বেশি কিছু।
ছায়াটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে শুরু করল, কিন্তু তার কন্ঠস্বর লরেনজোর কানে ভেসে এল, যেন মহলের প্রতিটি ইট থেকে সেই আওয়াজ আসছে। 'আমার নাম আলবের্তো। আমি এই মহলের মালিক ছিলাম। আমি আমার শিল্পকে ভালোবাসতাম, জীবনের চেয়েও বেশি। আমি চেয়েছিলাম আমার শিল্প অমর হোক। কিন্তু মানুষ আমার শিল্পকে সম্মান করেনি, তারা আমার জিনিস নষ্ট করেছে।' আলবের্তোর কন্ঠস্বরে গভীর দুঃখ আর হতাশা ছিল। 'আমি যখন মারা যাই, আমার আত্মা এই মহলে আটকা পড়ে যায়। আমি আমার শিল্পকে রক্ষা করতে চাই, যারা একে নষ্ট করে তাদের শাস্তি দিতে চাই।' লরেনজো বুঝতে পারল, আলবের্তো কেবল তার জিনিস নষ্ট করার প্রতিশোধ নিচ্ছিল না, সে তার অসম্পূর্ণ স্বপ্নের জন্য কষ্ট পাচ্ছিল। মহলের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে এখানে আটকে রেখেছিল।
লরেনজো উপলব্ধি করল যে সে কেবল একটি জিনিস নষ্ট করেনি, বরং আলবের্তোর অসম্মান করেছে, তার ভালোবাসার শিল্পকর্মকে অসম্মান করেছে। 'আমি দুঃখিত, আলবের্তো,' লরেনজো মৃদুস্বরে বলল। 'আমি জানতাম না আপনার এই মহলের সঙ্গে এত গভীর সম্পর্ক আছে। আমি আপনার জিনিস নষ্ট করে ভুল করেছি।' লরেনজোর কন্ঠস্বরে কোনো ভয় ছিল না, ছিল কেবল অনুতাপ। মহলের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল, যা ছিল আলবের্তোর দুঃখের প্রকাশ। ধীরে ধীরে, হলঘরের আসবাবপত্রগুলো তাদের জায়গায় ফিরে যেতে লাগল, আর বন্ধ দরজাটি আবার খুলে গেল। লরেনজো বিস্মিত হয়ে দেখল, মহলের ভেতর থেকে আসা বাতাস আর আগের মতো শীতল নয়, বরং এক ধরনের শান্ত অনুভূতি এনে দিচ্ছে।
মহলের পরিবেশ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল। আলবের্তোর আত্মা যেন লরেনজোর অনুতাপ বুঝতে পেরেছিল। প্রধান দরজাটি সম্পূর্ণভাবে খুলে গিয়েছিল, আর বাইরে মৃদু সূর্যালোক দেখা যাচ্ছিল। লরেনজো ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, আলবের্তোর আত্মা হয়তো তাকে মুক্তি দিচ্ছে। সে একবার পেছনে ফিরে তাকাল। মহলের ভেতরটা এখন আর ভুতুড়ে মনে হচ্ছিল না, বরং এক গভীর বিষাদময় শান্তি বিরাজ করছিল। লরেনজো জানত, সে এই মহলের কথা কখনো ভুলতে পারবে না। এই অভিজ্ঞতা তাকে জীবনের এক নতুন শিক্ষা দিয়েছিল। সে সাবধানে মহলের বাইরে পা রাখল, আর নির্মল বাতাসে শ্বাস নিল।
লরেনজো আর থামল না, সোজা তার মোটরবাইকের দিকে ছুটল। ইঞ্জিন চালু করে সে দ্রুত গতিতে মহল থেকে দূরে চলে যেতে শুরু করল। পেছনে তাকিয়ে সে দেখল, মহলের অন্ধকার জানালার ভেতর থেকে যেন একজোড়া চোখ তাকে অনুসরণ করছে। রাতের আকাশ তখন কালো মেঘে ঢাকা, আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বৃষ্টি শুরু হলো, আর লরেনজো যেন নিজের চোখের জলকে বৃষ্টির সাথে মিশিয়ে দিল। সে তার জীবনে এতটা ভয় পায়নি। মহলের প্রতিটি স্মৃতি তার মনে টাটকা ছিল, আর ভাঙা ঘড়ির টুকরোগুলো যেন তার আত্মার ওপর এক গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল। সে শপথ করল, জীবনে আর কখনো কোনো পরিত্যক্ত মহলের ধারে কাছেও যাবে না।
লরেনজো সুস্থ হয়ে উঠল, কিন্তু মহলের অভিজ্ঞতা তাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। সে আগের মতো দুঃসাহসী ছিল না, বরং তার মধ্যে এক ধরনের চাপা ভয় কাজ করত। রাতের বেলা তার ঘুম আসত না, আর যখনই সে কোনো পুরোনো জিনিস দেখত, তার মনে পড়ত সেই ভাঙা ঘড়ির কথা। সে তার বন্ধুদের কাছে মহলের গল্প শোনাল, কিন্তু কেউ তাকে বিশ্বাস করতে চাইল না। তারা ভাবল, লরেনজো হয়তো কল্পনার জগৎ থেকে কিছু একটা তৈরি করেছে। কিন্তু লরেনজো জানত, সে যা দেখেছে তা বাস্তব। মহলের অভিশাপ তার জীবনের ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সেই ঘটনা তাকে শিখিয়েছিল, কিছু রহস্যকে রহস্যই থাকতে দেওয়া ভালো। কিছু জিনিসকে তার নিজের জায়গায় থাকতে দেওয়া উচিত, কারণ তাদের সাথে জড়িয়ে থাকে এমন কিছু শক্তি, যা মানুষের কল্পনারও অতীত।
সেই দিন থেকে, লরেনজো এক নতুন মানুষ হয়ে গিয়েছিল। সে আর কোনো অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে বের হতো না, বরং নিজের জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলো উপভোগ করতে শিখল। মহলের গল্প তার মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল, যা তাকে আরও বিনয়ী এবং সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। সে আলবের্তোর জন্য প্রার্থনা করত, যেন তার আত্মা শান্তি পায়। ইতালির সেই নির্জন অঞ্চলে, মহলের গল্প আজও এক কিংবদন্তি হয়ে রইল। গ্রামবাসী এখনও সেই মহলের পাশ দিয়ে যেতে ভয় পায়, কিন্তু এখন তারা জানে, মহলটি কেবল একটি ভুতুড়ে স্থান নয়, এটি একটি আত্মাহীন শিল্পীর অমর শিল্পের প্রতীক, যা সম্মান ও শান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লরেনজো জানত, এই মহলের গল্প কেবল একটি ভূতের গল্প নয়, এটি সম্মান, অনুতাপ
এবং মুক্তির এক অসাধারণ কাহিনী।
••••••• সমাপ্ত •••••••
© Copyright Reserved •• Abhijit Halder