সেদিন ছিল বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট। মাত্র দুই নম্বরের জন্য পজিশনটা পিছিয়ে গেল আমার। তখন আমার ক্লাস ফোর। আমিই ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিলাম। সেবারে আর ফার্স্ট হতে পারলাম না। বাড়িতে বেঁধে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। বাবা বলল,
বাবার কথাতে মাও সায় দিয়ে বলল,
"আমার কলিগদের কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব বলো তো? কাল কলেজে ঢুকলেই প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে, মেয়ে কেমন রেজাল্ট করল? ছি ছি! বেঙ্গলিতেই মার্কসটা কম পেয়েছে। ভাবতে পারছ, ও যদি অমন কীর্তিটা না করত, ফার্স্ট হতে ওকে কেউ আটকাতে পারত?
বেশ মনে আছে আমি তখন চুপটি করে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভিতর জমে আছে শিশু মনের উথাল পাতাল দুঃখ। প্রকাশ করার জায়গাটা আমার নেই। আমি অতো বড়ো ভুলটা যদি না করতাম, তাহলে হয়তো ফার্স্ট হতেই পারতাম? উঁহু ,আমি নয়, আমার বাবা মা-ই তখন মনের মধ্যে রোপণ করে ফেলেছে এমন ধারণা।
ভাবছ তো আমি কি ভুল করেছিলাম? স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নে রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছিল, তোমার জীবনের লক্ষ্য। আমার টিচার আমাকে খাতায় লিখে দিয়েছিলেন বড়ো হয়ে আমি ডাক্তার হাতে চাই। কারণ বইতেও অমনই লেখা ছিল, ওটা লিখলেই ভালো মার্কস পাওয়া যেত। কিন্তু আমি তো সত্যিই ডাক্তার হতে চাই না। মিথ্যে লিখতে মন চায়নি সেদিন। নিজের মতো করে নিজের ভাষায় লিখলাম আমি ফটোগ্রাফার হতে চাই। জীবনের এত বড়ো সত্যি কথাটা লিখেও আমি ভুল বলে প্রমাণ হয়ে গেলাম সেদিন। মা আর বাবা বুঝিয়ে দিল, আমি বেয়াদব হয়ে যাচ্ছি ,আমার জন্য বাবা মায়ের সম্মান নষ্ট হতে বসেছে। খুব কষ্ট হচ্ছিল সেদিন। চোখের জল চোখেই শুকিয়ে ছিল সেদিন।
আমি বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। বাবা ডাক্তার, আর মা কলেজের অধ্যাপিকা, মা সোসিওলজি পড়াতেন। ছোটো থেকেই আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন তাদের একমাত্র মেয়েকে মনের মতো করে মানুষ করবেন। বাবার কিছু স্বপ্ন আর মায়ের কিছু স্বপ্ন একত্রে করে আমার ওপর চাপিয়ে দিলেন। তাদের মেয়ে হয়ে উঠবে সর্ব গুণে গুণান্বিত। কোনো দিকটাই যেন বাদ না পড়ে। যতই হোক বাবা ডাক্তার আর মা প্রফেসর। নিজেদের একটা স্ট্যাটাস তো আছে, তা না হলে মুখ দেখানো যে ভার হয়ে উঠবে। বাবা চান মেয়ে সুইমি়ং ক্লাবে যাক, ছবি আঁকা শিখুক। আর মা চান মেয়ে নাচ,গান আর কম্পিউটার শিখুক। আর সেই সঙ্গে পড়াশোনাটাও করতে হবে, এমন ভাবে পড়াশোনা করতে হবে যেন আমার আগে কেউ না থাকে, অর্থাৎ ফার্স্ট হতে হবে। সেই দম দেওয়া ঘড়ির মতো। সোমবার থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত পড়াশোনার জগৎ। শনিবার বিকেল থেকে রবিবার রাত পর্যন্ত নাচ, গান,ড্রয়ি়ং ক্লাস, সুইমি়ং ইত্যাদি। আর আমি? আমি কি চাই, কি করতে ভালোবাসি সে সব না দেখলেও চলবে। শনিবার বিকেল থেকে রবিবার রাত পর্যন্ত সময়টুকু ছিল আমার কাছে বিভীষীকা। রবিবারটা নাকি ছুটির দিন? কিন্তু আমার কাছে সেটা ছুটির দিন কোনো কালেই ছিল না। খুব ইচ্ছে হতো, রবিবার সকাল বেলা দেরি করে ঘুম থেকে উঠব, সকালে ব্রেকফাস্টে মা গরম গরম ফুলকো লুচি আর আলু ভাজা দেবে, আমি মনের সুখে খাব, টিভিতে কার্টুন দেখব, দুপুরে চিকেন বা মটন, তারপর একটু জমিয়ে ঘুম। তারপর বিকেল বেলা বাবা মায়ের সাথে ঘুরতে যাব, সন্ধ্যে বেলা টিভিতে মুখ গোঁজা, আর রাতে শান্তিতে ঘুমোব। না, কোনো দিন পাইনি এই রবিবারটা। বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে নিজের শৈশবটা হারিয়ে ফেললাম।
রবিবার সকাল হলেই মা নিয়ে চলে যেত গানের ক্লাসে। গান শেষ তো একটু স্যান্ডুইচ খাইয়ে নিয়ে ছুটলো আঁকার ক্লাস। তারপর বাড়ি এসে লাঞ্চ করিয়ে সুইমি়ং ক্লাস, তারপরে নিয়ে চললো কম্পিউটারে। মনে পড়ে রবিবারের বিকেল গুলো। সুইমিং করে ফেরার পথে দেখতাম বস্তির ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে গুলোকে। তাদের মা কত পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছে ওদের। ধুলো কাদা মাখা পোশাক পরেও মুখে কত হাসি। মেয়ে গুলোকে চুলটা সুন্দর করে বিনুনি করে দিয়েছে ওদের মা। কি সুন্দর বিনুনি পিঠের উপর পড়ে আছে। আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম। আর দেখলেই মা ভীষণ বকত। মনে মনে কষ্ট পেতাম কারণ আমার তো ছোট চুল, বড়ো চুল রাখতে দেয় না আমার মা। আমার ভালো লাগতো প্রকৃতির নানা রূপ দেখতে। একদিন অবাক হয়ে দেখছিলাম সূর্য ডোবার দৃশ্যটা। সূর্যটা ডুববে ডুববে, সেই সময় এক ফালি কালো মেঘ এসে পুরো সূর্যটাই ঢেকে দিল। অবাক হয়ে দেখছি,ওমনি মা বলে উঠল,
-আবার উল্টো দিকে তাকাচ্ছিস তো। আগের দিন হোঁচট খেয়ে পড়লি, তোর শিক্ষা হবে না দেখছি।
বললাম,
-আমি তো সূর্যের ডুবে যাওয়াটা দেখছি। আর তুমি আমাকে টেনে নিলে?
আসলে মা ছিল ওই মেঘটার মতো। সব ভালো জিনিসকে যেমন মেঘ ঢেকে কেমন একটা অন্ধকার করে তোলে তেমনি আমার মাও।ভাবতাম এত সহজ না, সূর্যকে ঢেকে দেওয়া।আজ ঢেকেছে তো কি হয়েছে, কাল কিন্তু আবার পূবের আকাশে দেখা দেবেই।
রাস্তায় যেতে যেতে দেখতাম আমার মতো কত ছেলে মেয়ে এক সাথে খেলা করছে, খুব মন খারাপ করত ওদের দেখে। মনে হত মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে মিশে যাই ওদের সাথে। ওদের হাত ধরে খেলতে শুরু করি। ওরা কি সুন্দর কানামাছি খেলে, বুড়ি ছোঁয়া খেলে। আমি কোনো দিন এমন সুযোগ পাইনি। তারপর যেদিন বক গুলো ডানা মেলে নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছিল, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম আর ভাবছিলাম, একটা ক্যামেরা থাকলে বন্দী করতে পারতাম ওদের। মা'কে ডেকে বললাম,
-মা দ্যাখো দ্যাখো ওরা ডানা মেলে কেমন ভেসে বেড়াচ্ছে। কত স্বাধীন বলো,যেখানে খুশি যাচ্ছে। একটা ক্যামেরা কিনে দেবে? ওদের ছবি তুলবো।
এ কথা বলতে মা বলেছিল,
-এসব দেখে কাজ নেই। সময় নষ্ট না করে মন দিয়ে পড়াশোনা করো।
জানালায় বসে দেখতাম গাছের পাতায় বৃষ্টির টুপ টুপ করে জল পড়ার দৃশ্য,সে এক অদ্ভুত ছবি। মনের ক্যামেরাতেই ধরে রাখতাম। কিন্তু এসব নাকি ফালতু জিনিস বাবাও বলতো। মনে হতো সারাদিন ছবি তুলি। বাবাকে বললাম সে কথা।বাবা বলল,
-বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে হবে। এই অবাস্তব ভাবনা গুলো মন থেকে বের করে দাও।
আমার ইচ্ছের মূল্য বাবাও দিল না,মাও শুনল না। বাবা মা আসলে যা চাইছে, ওই গুলো আমার মনের কথা কিনা,আমি আসলেই অমনটাই চাইছি কিনা, আমার থেকে জানতে চাওয়া হলো না। আমি কি করতে ভালোবাসি সেটা বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থই হয়েছি বার বার। ভালো মার্কস, ভালো রেজাল্ট, বড়ো ডাক্তার হওয়া, সবকিছুর জন্য কি নিপুণ অভিনয় করতে হচ্ছে আমাকে। অথচ এই আমিটা আমার না, এই মেনে নেওয়াতে যে আমি নেই, সে কথা কে বুঝবে? চোখে মুখে মিথ্যে আগ্রহের শিল্প এঁকে দিয়ে তার বিনিময়ে আমাকে দিয়ে মুগ্ধতা কিনতে চেয়েছে আমার বাবা মা! আমার শৈশব টাই একদিন হারিয়ে গেল বাবা মায়ের ইচ্ছের ভীড়ে। আর কোনো দিনই ফেরাতে পারলাম না সে ছোটো বেলা।
যেই একটু বড়ো হলাম ওমনি আমার পড়াশোনা নিয়ে পড়লো মা বাবা দুজনেই। ছবি আঁকা, সুইমিং, গান, সব হারিয়ে গেল কোন অতলে। কারণ তাদের মেয়েকে ডাক্তার হতে হবে। জয়েন্টের জন্য পড়াশোনা দিন রাত। যে কোনো মূল্যে ডাক্তারিতে চান্স পেতেই হবে। অবশেষে মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলাম। বাবা মা দারুণ খুশি। আমি খুশি হতে পারলুম না। তারপর এম. বি. বি এস পড়তে চলে গেলাম বাঁকুড়াতে।
সেই প্রথম আমার ছাড়পত্র পাওয়া, মানে বাড়ি বাইরে থাকার একটা ছাড়পত্র পেয়েই গেলাম । দেখলাম বাইরের জগৎ। কিন্তু আমাকে যে ডাক্তার হতেই হবে এমন স্বপ্ন কখনোই মনের মধ্যে রোপণ করিনি। আমার প্যাশন যে ফটোগ্রাফি। সে শখ আমাকে পূরণ করতেই হবে। বাবা মা কে বললেই হয়তো রে রে করে তেড়ে আসবে। ভাবলাম নিজেই সে শখ পূরণ করবো। সে সুযোগ আমাকে ঈশ্বর দিলেন। ইন্টার্নশিপ করার সময় হাতে যে টাকা পেলাম সেটা জমিয়ে তাতেই কিনে ফেললাম একটা ক্যামেরা। তারপর আমি আমার লক্ষ্যে চলতে লাগলাম। এদিকে আমার এম.বি.বি.এস ও কমপ্লিট হয়ে গেল, আর আমি আমার প্যাশন নিয়ে পড়লাম। নিজের প্যাশনটা যে কখন পেশা হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। তারপর আর পিছন ফিরে তাকিয়ে থাকতে হয় নি। এই ফটোগ্রাফি এমন একটা জায়গা দিল আমি পৌঁছে গেলাম ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ম্যাগাজিনে, আমার কয়েকটা ছবি জায়গা করে নিল ম্যাগাজিনের পাতায়। ওখানে কাজ করতে করতে আমার পরিধি আরও বিস্তৃত হতে লাগলো। বিভিন্ন পুরষ্কার আর সম্মানে আমি সম্মানিত হলাম নানান জায়গা থেকে। আমার প্যাশন হয়ে গেল পেশা। তার পর থেকেই চলছে জীবন। এখন বাবা মা আমার ফটোগ্রাফি নিয়ে ভীষণ গর্ববোধ করেন, তাদের মেয়ের সুনাম যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বাস করো, বাবা মায়ের এমন উচ্ছ্বাস আনন্দ কেন জানিনা আমাকে আনন্দ দেয় না। আমি আজও ক্ষমা করতে পারিনি বাবা মাকে, আমার শৈশবটা কীভাবে চুরি করে নিয়েছিল, সেই ক্ষত অবচেতনে রয়েই গেছে। তবে আমি আনন্দ পাই আমার এন জিও তে পথ শিশুদের জন্য কিছু করতে পেরে। ছোটো থেকেই দেখতাম বস্তির ছোটো ছোটো বাচ্চাদের। কেমন ওরা অর্ধাহারে,অনাহারে থাকে। ওদের জন্য ভীষণ মায়া হতো। মনে মনে ঠিক করে রেখে ছিলাম ভবিষ্যতে ওদের জন্য আমি কিছু করবই। আর সেই স্বপ্নটাও সার্থক করতে পেরেছি নিজের চেষ্টায়। ওদের দেখাশোনা, চিকিৎসা সব নিজের হাতে সামলাই। সেবা করাটাই আমার মূল লক্ষ্য। ছোটো বেলায় যে গুলো আমি পাইনি বা পারিনি, সেই পাওয়া গুলো এখন পথ শিশুদের মধ্যে দিয়ে পাই। তাই তো আমার রোজগারের সমস্ত টাকা ওদের জন্য। ওদের সুখেই যে আমার সুখ।
ম্যাডামের কথা গুলো শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। জীবন কত বিচিত্র। জীবনে কত প্রতিকূলতা। শৈশবের কত শখ, কত ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যায়। সন্তানের ইচ্ছে অনিচ্ছার কোনো মূল্য না দিয়েই অনেক বাবা মা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চান। কিন্তু তাতে ফল হয় উল্টো। ম্যাডামের মত জীবন দর্শন বা মনের জোর হয়তো সবার থাকে না। অনেক প্রতিভার অঙ্কুরেই বিনষ্টি ঘটে। উপলব্ধি করলাম, জীবনের একটা পর্যায়ে এসে মনে হবেই, আমি যা চেয়েছি, তা আমি হইনি। আমি যা হয়েছি, তা আমি চাইনি। সারা জীবন মুখোশ পরেই রয়ে গেলাম, নিজের সঙ্গে নিজেকে লড়াই করতে হবে সারা জীবন, সকলের সামনে অভিনয় করেই বুঝিয়ে দিই হ্যাঁ এটাই আমি, আসলে আমি জানি এটা আমি নই। সেই মুহুর্তে ম্যাডামকে ঠিক কি বলা উচিত সেটাই ভেবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ম্যাডাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
জানো সন্দীপ, জীবনের যে গল্পটা আমরা কাউকেই বলতে পারি না, আমরা সেই গল্পের মধ্যেই আমরা সব মানুষ বেঁচে থাকি। আর এটাই জীবনের সব থেকে বড়ো ট্রাজেডি।